শোক আখ্যান 'শ্রাবণ ট্র্যাজেডি'

‘আমাকে মারলে কেন, চাচা’—ছোট্ট শিশুর প্রশ্ন তার ‘মোশতাক চাচা’র কাছে। আতঙ্কে কেঁপে ওঠে মোশতাক চাচা। চিৎকার করে শিশুটিকে বলে, ‘৩২ নম্বরে ফিরে যা।’ এবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিশু বলে, ‘কী করে যাব। আমাকে কোলে নেওয়ার কোল কোথায় ওখানে? সব কোল তুমি কেড়ে নিয়েছ, সিঁড়িতে-বারান্দায়-ঘরে শুধু রক্ত আর রক্ত। ও চাচা, আমাকে মারলে কেন’—শিশুর প্রশ্নটি যেন ঘুরতে থাকে জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে, ডুকরে কেঁদে ওঠে চারপাশ। দর্শকসারিতে বসা অনেকের দুচোখ ছলছল করছিল।

জাতীয় নাট্যশালা মঞ্চে তখন শ্রাবণ ট্র্যাজেডি নাটকের শেষ দৃশ্য। ১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয় এ নাটকের। ঢাকার মঞ্চে নতুন এ নাটক এনেছে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়। মহাকালের ৪০তম নাট্য প্রযোজনাটি লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনন জামান। নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশিক রহমান।

নতুন নাটক উদ্বোধন হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে আনন্দমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে তা উদ্‌যাপন করা হয়। কিন্তু সেদিন রোববার সন্ধ্যায় ব্যতিক্রম দেখা গেল, শ্রাবণ ট্র্যাজেডি নাটকের উদ্বোধন হয়েছে ভায়োলিন, বাঁশি আর সেতারের করুণ সুরে। সঙ্গে নাট্যকর্মীদের সমবেত কণ্ঠে গান, ‘বঙ্গবন্ধু মরে নাই, বাতাসে কান পাতলে বজ্রকণ্ঠ শুনতে পাই...’। অতিথিরা প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন।

পিনপতন নীরবতায় শুরু হয় নাটক। অন্ধকার মঞ্চে আলো পড়তেই তিনজন কথক আসেন। আহ্বান জানান সেই বঙ্গবন্ধুকে, যাঁর জন্য এ দেশে স্বাধীনতা এসেছে। পেছনের পর্দায় ভেসে ওঠে চিরচেনা বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। শেষ কথক বলেন, অথচ এই মহান মানুষকে কী নির্মমভাবে মারল ষড়যন্ত্রকারীরা। কবিতার মতো করে সংলাপগুলো বলে যান তাঁরা। কথকের বর্ণনার পর দেখা যায়, খুনিরা সাঁজোয়া যান নিয়ে ছুটছে ৩২ নম্বরের দিকে। তারা ঘটাতে যাচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। নাটকের পুরো আবহ তৈরি হয় এখান থেকেই। দর্শকদের বুঝতে বাকি রইল না, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবার-পরিজনদের সুপরিকল্পিতভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শোক আখ্যান এটি, যাতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড, হত্যার পরিকল্পনাকারী রাজনৈতিক ও সামরিক বেনিয়াদের অংশগ্রহণ ও কার্যকারণ। নাটকে তুলে ধরা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পনা এবং সেটি বাস্তবায়ন কীভাবে হয়েছে, তা। এসেছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নানা দিক।

১ ঘণ্টা ২৮ মিনিটের নাটক। পুরো সময়টাতে মনে হয়েছে একদল লোক ইতিহাস বলে যাচ্ছে, যেখানে কিছু খণ্ড খণ্ড ঘটনার ছবি দেখা গেল, যেখানে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রত্যক্ষ পরিকল্পনাকারী দোসরদের অংশগ্রহণ ও কার্যকারণ উন্মোচিত করার চেষ্টা করেছেন নির্দেশক। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও রাষ্ট্র গঠনে তাঁর চেষ্টা তুলে ধরা হয়েছে মঞ্চে, যেখানে দর্শকের মানসে একেক সময় একেক অনুভূতি ঠায় নেয়। বিস্ময়, ঘৃণা, ক্রোধ ভর করে দর্শকের মনে। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে! এত সহজে এত বড় মহান একজন মানুষকে কীভাবে শেষ করে দিতে পারে! নাটকের শেষ দিকে নাট্যকার আরেক চরিত্র সুলতানা কামালের মুখে বলিয়েছেন, ‘জানো নাকি মানুষ, শ্রাবণ কতটা শ্রাবণ হলে ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটার রক্তচিহ্ন মুছে দেওয়া যায়? জানেন আপনারা কেউ? শেষ পর্যন্ত এ প্রশ্নটি নিয়ে দর্শক মিলনায়তন থেকে বের হয়।

ইতিহাস আশ্রিত নাটক মঞ্চে আনা যে খুবই দুরূহ একটা কাজ, সেটা নাটক দেখতে বসলে ঢের টের পাওয়া যায়। শ্রাবণ ট্র্যাজেডি নাটক দেখতে দেখতে তেমনটা মনে হচ্ছিল। নাটকটি দেখার সময় দর্শক হিসেবে আমার মনেও একই প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে, তারপর কী হলো? অবশ্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে সমালোচকের চোখে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিই ধরা পড়বে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মঞ্চে থাকা শিল্পীদের অতি অভিনয়, সংলাপ প্রক্ষেপণ—এসব নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। সেদিকে আমরা যাচ্ছি না আজ। বরং কথা বলি মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি মীর জাহিদ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দীর্ঘ নয় মাস গবেষণালব্ধ এ পাণ্ডুলিপিতে জাতির জনককে হত্যার পরিকল্পনাকারী রাজনৈতিক ও সামরিক বেনিয়াদের অংশগ্রহণ ও কার্যকারণ উন্মোচিত হয়েছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জানার অধিকার রয়েছে। তিনি মনে করেন, মহান নেতার হত্যাকারী রাজনৈতিক ও সামরিক বেনিয়া আর খুনিদের মুখোশ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে সতর্ক করা এবং খুনি ও তাদের অনুসারীদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করার প্রত্যয় তৈরিতে ভূমিকা রাখবে এ নাট্য প্রযোজনা।

নাটকটিতে অভিনয় করেছেন মীর জাহিদ হাসান, কবির আহামেদ, ফারুক আহমেদ, মো. শাহনেওয়াজ, মনিরুল আলম, সামিউল জীবন, রাজীব হোসেন, শিবলী সরকার, শাহরিয়ার হোসেন, তারেকেশ্বর তারোক, আহাদুজ্জামান কলিন্স, সুমাইয়া তাইয়ুম, আরাফাত আশরাফ, কাজী তারিফ, তাজুল রনি, আকতার মায়া, রিফাত হোসেন, ইকবাল চৌধুরী, মীর নাহিদ আহসান প্রমুখ।