বটতলার ১০

ক্রাচের কর্নেল নাটকের দৃশ্য
ক্রাচের কর্নেল নাটকের দৃশ্য

একটা নতুন দল করতে হবে, যেটি থাকবে একেবারেই উন্মুক্ত জায়গা। যেকোনো দল থেকে যে কেউ এখানে এসে অভিনয় করতে পারবেন। আজ থেকে ১০ বছর আগে এই চিন্তা থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল কিছু স্বপ্নবান তরুণের। কারণ তত দিনে খেপাটে নাটকগুলো প্রায় মঞ্চ ছাড়া। দর্শক নেই, দর্শক নেই বলে হাহাকার ওঠে প্রতিনিয়ত। তরুণগুলো নাটক বানালেন। মঞ্চে এল খনা, ক্রাচের কর্নেল-এর মতো নাটক। দর্শকেরা নাটক দেখেন, আলোচনা করেন, অংশগ্রহণ করেন এই দলের সঙ্গে নানা কাজে। আর দেখতে দেখতেই দলটি পেরোল ১০টি বছর। যাকে এক দশক বলা যায়। দলটির নাম—বটতলা।

শুরুর দিকের কথা শুনতে চেয়েছিলাম দলটির সৃজনশীল পরিচালক মোহাম্মদ আলী হায়দারের কাছ থেকে। তিনি স্মৃতিচারণা করে ফিরে গিয়েছিলেন ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে। ‘আমরা কয়েকজন মিলে ২০০৮ সালে ভাবছিলাম যে, এমন একটা দল করা যায় যেখানে কোনো বাধা থাকবে না। ইচ্ছে হলে আমি অন্য দলে কাজ করতে পারব। অন্য দলের লোকজন এখানে কাজ করতে পারবে। একটা উন্মুক্ত ও স্বাধীন একটা জায়গা থেকে আমরা বসলাম। এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম যে, হ্যাঁ এমন একটা জায়গা তৈরি করাই যায়।’

সেই থেকে দলটির নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল ‘আ পারফরম্যান্স স্পেস’ কথাটি। কিন্তু এটা তো আর নাম হয় না। একটা নাম তো দিতে হয়। আলী হায়দার বলেন, ‘প্রথমেই বিপাকে পড়ি দলের নাম নিয়ে। অনেকগুলো নাম ঠিক করা হয়। তার থেকে ২৫টি বাছাই করা হয়। পরে চিন্তা করলাম কাকে দেব এই নাম বাছাই করতে। অবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার শিক্ষক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আজফার হোসেনের ওপর দায়িত্ব দিই। তিনি নাম ঠিক করে দেন ‘বটতলা’। সবার পছন্দ হয় এই নাম। কারণ বটতলা এমন একটি জায়গা যেখানে এ দেশের পারফরম্যান্সের শুরু।’

নাম প্রস্তুত। বটতলারই একজন লেখক ও শিল্পী আসলাম লিটন লোগো তৈরি করে দেন। এটিও সবার পছন্দ হয়। এ বিষয়ে সবাই একমত হন যে বটতলা হবে একটি উন্মুক্ত নাট্য প্রয়োগের স্থান। এখানে যেকোনো দলের যে কেউ এসে অভিনয়, নির্দেশনা, ডিজাইন, কর্মশালা করতে পারেন। এ জন্য কাউকে এর সদস্য হতে হবে না। সবাই তাঁর সৃষ্টিশীলতার জায়গা থেকে নিজের মতো করে নির্মাণ করবেন নতুন কিছু। কিন্তু এই পুরো আয়োজন সামনে নিয়ে যেতে হলে একটা দল দরকার। যদিও বড় কমিটি করে ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো ইচ্ছা তাদের নেই। কাজটাই মুখ্য। তাঁরা তিনজনের ছোট কমিটি করে ফেলেন। শুরু হলো যাত্রা।

দল বানালেই তো হবে না। এবার কাজে নামার পালা। নাটক বানাতে হবে। কী নিয়ে বানানো যায়? সবাই ভাবছে। এরই মাঝে ঢাকায় ঘটল একটি মর্মান্তিক ঘটনা। সেই ঘটনা নিয়েই বটতলা তৈরি করে তাদের প্রথম নাটক একজন রুহুল আমিন। আলী হায়দার বলেন, ‘তখন দেশে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। র‍্যাংগস ভবন ভেঙে রাস্তা বানানোর আদেশ আসে। ভাঙা শুরু হয়। কিন্তু ভবন ভাঙায় তাড়াহুড়া ও দক্ষতার অভাবে নিহত হন কয়েকজন শ্রমিক। ভাঙার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। একজন শ্রমিকের মৃত লাশ ঝুলে থাকে ভাঙা দালানের লোহার রডে। এর প্রতিবাদে বটতলার নাট্যকার সামিনা লুত্ফা নিত্রা একদিন একটি গল্প লেখেন। বটতলার আরেক কর্মী ব্রাত্য আমিন এটিকে নাট্যরূপ দেন। পরে তাঁরই নির্দেশনায় তৈরি হয় বটতলার প্রথম নাটক একজন রুহুল আমিন।

পথচলা শুরু হলো। আলী হায়দার বলেন, ‘তত দিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেষের দিকে চলে যায়। একটা সরকার ক্ষমতায় এসে না বুঝে কত অন্যায় করে সেটা মানুষ যাতে বুঝতে পারে, মানুষ যাতে ভুলে না যায় সেই বার্তাটি দেওয়ার জন্যই এই নাটকটি করা। পরে আমরা বুঝে গেলাম, আমরা লাইনটা পেয়ে গেছি। মানুষের কথা বলতে হবে। মানুষের কথাই এখনো বলছি।’

বটতলার প্রযোজনাগুলোর দিকে তাকালে এটি বোঝা যায়। বাংলার চিরায়ত গ্রামীণ মেলা নিয়ে তৈরি হয় নাটক ধামাইল। পুরুষতান্ত্রিকতা দিয়ে নারীর জ্ঞানকে অসম্মান নিয়ে নাটক খনা। তাজরীন গার্মেন্টস আগুনে পুড়ে নিহত পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে জতুগৃহ। নিয়ে আসেন আফ্রিকার রাজনৈতিক নাটক দ্য ট্রায়াল অব মাল্লাম ইলিয়া। তৈরি হয় মধুশিকারী, সুন্দরবন কথা, আর নয় চুপ থাকা, বন্যথেরিয়াম। আর বটতলাকে নতুন করে চিনিয়েছে যে নাটকটি, সেটি ক্রাচের কর্নেল। শাহাদুজ্জামানের উপন্যাস অবলম্বনে এই প্রযোজনাটি নাটকের দলটিকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ঢাকার মঞ্চে জনপ্রিয় ও ভালো নাটকগুলোর মধ্যে এটি একটি।

১০ বছরে বটতলা দিয়েছে ১০টি নাটক। নাটক নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশের নানা প্রান্ত। প্রদর্শনী করেছে বিদেশেও। তবে এই ১০ বছরের পথচলা একেবারেই মসৃণ ছিল না। মিলনায়তন পাওয়া থেকে শুরু করে নাটক প্রদর্শনী—বাধা এসেছে পদে পদে। সবকিছু উতরে বটতলা এখন ১১ বছরে। তরুণ স্বপ্নবান এই দলটির এখন কৈশোর মাত্র। পেরোবে তারুণ্য, যৌবন। পৌঁছে যাবে আরও দূরে।