ফর্মুলার ঘেরাটোপে

জান্নাত ছবিতে অভিনয় করেছেন মাহিয়া মাহি ও সাইমন
জান্নাত ছবিতে অভিনয় করেছেন মাহিয়া মাহি ও সাইমন
ঈদুল আজহা উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছিল চারটি ছবি—ক্যাপ্টেন খান, মনে রেখো, জান্নাত ও বেপরোয়া। এর মধ্যে বেপরোয়া ঢাকার বাইরে মাত্র একটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তারপর আর কোনো প্রেক্ষাগৃহে চলার খবর পাওয়া যায়নি। গত ৩০ আগস্টের আনন্দে ছাপা হয়েছিল ক্যাপ্টেন খান ও মনে রেখো চলচ্চিত্রের সমালোচনা। আজ ছাপা হলো জান্নাত ছবির সমালোচনা। 


২‍+২=৪। বাংলা সিনেমায় দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর এই ব্যাপার-স্যাপার আকছার ঘটে। ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’-এর মতো ছবির অন্তিমে থাকে নায়ক-নায়িকার মিলন। এর বাইরেও আরও নানা পদ্ধতিতে চার মেলানো সম্ভব। যেমন ১+১+১‍+১=৪ অথবা ৩‍+১=৪। মোদ্দা কথা, অঙ্কের যোগফলটি চারেই মেলাতে হবে; এবং যেকোনো পন্থায় ঢাকাই সিনেমার কাহিনিতে সেটি মেলানোও হয় কম-বেশি। এই ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত জান্নাত ছবিতেও ঘটেছে এই ‘চার’ মেলানো কাণ্ড। তবে ছবির শেষ পর্যায়ে এসে এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে পরিচালক চিরাচরিত হিসাব ২‍+২=৪—এর কিঞ্চিৎ বদল ঘটিয়ে খানিকটা অন্যথা ঘটিয়েছেন। ফলে ছবি শেষে যোগফল কেবল চারেই আটকে থাকিনি, খানিকটা ভিন্ন রকমও হয়েছে।

কীভাবে? সেটি অবশ্যই বলব। এর আগে ঢাকাই ছবিতে বহু চর্চিত আরও একটি বৈশিষ্ট্য, যা ইতিমধ্যেই ক্লিশে হয়ে উঠেছে, তার খানিকটা উল্লেখ করা যাক।

ফমুর্লানির্ভর অধিকাংশ ঢাকাই ছবিতে নির্দিষ্ট ঘটনা—বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মারপিট—ঘটে যাওয়ার পরেই সাধারণত দৃশ্যপটে হাজির হয় পুলিশ (এ-ও এক দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো কারবার)। মোস্তাফিজুর রহমান মানিক পরিচালিত জান্নাত-এ তা দুইয়ে দুইয়ে চার ঘটেছে চারবার। একটি মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ ছবিতে নায়ক আসলাম বা ইফতেখার যখন প্রথমবার দখলবাজদের যথেষ্ট মারধরের মাধ্যমে কাবু করে তাদের হাত থেকে মাজারকে রক্ষা করল, তখনই দৃশ্যপটে হাজির পুলিশ, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’।

আবার, নায়ক সাইমনকে পুলিশ দুই-দুইবার গ্রেপ্তার করলেও দুবারই তাদের সামনে দিয়ে একই কায়দায় পালাল বলশালী নায়ক। পুলিশের তখন কাজ কী? পুলিশ তখন রাত-দিনব্যাপী নায়কের পেছনে ছুটছে, ছুটছে আর ছুটছে।

ঢাকার সিনেমার চিরপরিচিত এসব ঘটনায় একধরনের ছদ্ম নাটকীয়তা তৈরির জবরদস্তিতে ২+২=৪ এই সরল অঙ্ক থাকলেও অনেক সময় বাস্তবতার মাটি থেকে ছবিকে সরিয়ে নেয়। আলোচ্য জান্নাত-এর ক্ষেত্রে তা নিদারুণভাবে ঘটেছে।

জান্নাত-এর কাহিনিতে আছে সমসাময়িক গুরুতর ঘটনা—জঙ্গি সমস্যা ও জঙ্গি দমন। ছবিতে একটি মাজারে আশ্রয় নেয় নায়ক সায়মন। আমরা জানতে পারি, তার নাম আসলাম। এরপর মাজারের খাদেমের মেয়ে জান্নাত চরিত্রের মাহির সঙ্গে তার প্রেম। পারিবারিক সম্মতিতে সেই প্রেম যখন বিয়েতে গড়াচ্ছে, তখনই হাজির নাটকীয়তা। জানা গেল, এই আসলাম নামের নায়ক আসলে ইফতেখার; এবং সে একজন জঙ্গি।

ভাবছেন, ছবির কাহিনি তো জানাই হয়ে গেল। না, এখানে আরও অনেক ‘প্যাঁচ’ আছে। যেমন নায়িকার বাবা ও মাজারের খাদেম যখন গোটা ছবিতে কাহিনিকার ও পরিচালক ২‍+২=৪ এই চেনা ছকে রাখলও সিনেমার একদম শেষ পর্যায়ে যোগফল ঠিক রেখে ছকটি একটু বদলে দিয়েছেন। শেষ অব্দি কাহিনির অন্তিমে কিছুটা অভিনবত্ব পাওয়া গেছে—নায়কের বুকে পিস্তল ধরেছেন নায়িকা, তারপর পরমুহূর্তের টেনশন...নায়ককে কি সে খুন করে ফেলল? এর বেশি ফাঁস করা বেয়াকুবি হবে, তবে এটুকু বলি, ছবির এই শেষ মুহূর্তের ঘোরপ্যাঁচে ফর্মুলানির্ভর জান্নাত-এর ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে বৈ কমেনি।

প্রধান পাত্রপাত্রী আলী রাজ, মিশা সওদাগর, মাহি বাণিজ্যিক মালমসল্লা-সহযোগে অভিনয় করেছেন। তাঁদের অভিনয়কে মেনে নেওয়া গেলেও সাইমনের অভিনয়কে চলনসই বলা একটু কঠিনই হবে। বিশেষত, পুরো ছবিতে যখন তিনি থেমে থেমে একটি নির্দিষ্ট সুরে (অনেকটা কবিতা আবৃত্তির ঢঙে) সংলাপ বলেন, সেটি একঘেয়েই লাগে কানে। তবে গানের দৃশ্যে সাইমনকে ভালো লেগেছে। তারপরেও বলতে হবে, গানের দৃশ্যায়ন এবং ছবির চিত্রায়ণে আধুনিকতার ছাপ আছে। চাইলে চোখ ও মন দুই-ই মজতে পারে তাতে। কিন্তু ছবির ঘাটতি এক জায়গাতেই—বাস্তবতার নির্মাণে। পাত্রপাত্রীদের অনেক সংলাপ ছিল দীর্ঘ এবং কাব্যাক্রান্ত, যা ক্ষেত্রবিশেষে বিরক্তির উদ্রেক করেছে।

জান্নাত কাহিনিচিত্রে বাংলাদেশের সমকালীন জঙ্গি সমস্যাকে বিষয় হিসেবে ধারণ করতে চেয়েছেন পরিচালক। তিনি অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন এ জন্য। তবে জঙ্গি সমস্যাকে বড় পর্দায় পুঙ্খানুরূপে ফুটিয়ে তোলার জন্য যে পরিমাণ গবেষণা এবং যতটা পরিপ্রেক্ষিত তৈরির প্রয়োজন ছিল, পুরো সিনেমার তার লেশমাত্রও নেই। কাহিনি রচনা থেকে শুরু করে এর দৃশ্যায়ন ও অভিনয়-প্রতিটি পর্বে আরও মনোযোগী হওয়ার অবকাশ ছিল। তাহলে ফর্মুলার মধ্যে থেকেও জান্নাত যথার্থ ঝলমলে আর বিনোদনপূর্ণ হয়ে উঠত বলে মনে হয়।