'যেদিন রিহার্সাল রুম মুছতে পারবে, সেদিন থিয়েটার করতে পারবে'

একটি টিভি নাটকের দৃশ্যে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম ও অমল বোস
একটি টিভি নাটকের দৃশ্যে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম ও অমল বোস

মঞ্চে তখন তেমন পয়সা আসত না। সেটা ছিল কেবলই সততা, উদ্যম, নিষ্ঠা ও একাগ্রচিত্তে কাজ করার দিন। নাটক তখন ছিল এক অন্য রকম আরাধনা। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি যেটুকু ছিল, শ্রম দিয়ে তা পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন সবাই। সেই সময় কিছু নাটকপাগল মানুষ ছিলেন। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা জীবনকে তুলে দিয়েছিলেন থিয়েটারের হাতে। সৈয়দ মহিদুল ইসলাম ওই দলের প্রথম সারির একজন।

১৯৭৭ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) থেকে নাট্যতত্ত্বে স্নাতকোত্তর করে এসেছিলেন সৈয়দ মহিদুল ইসলাম। সহপাঠী হিসেবে সেখানে পেয়েছিলেন রাজ বাব্বর, স্মিতা পাতিল, নাসিরউদ্দিন শাহকে। তাঁর সেই পড়া ঢাকার নাটককে সমৃদ্ধ করতে কাজে দিয়েছিল। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় তিনি চালু করেছিলেন ‘স্কুল অব অ্যাকটিং’। অভিনয় শিখে ঢাকার ছেলেমেয়েরা অভিনয়শিল্পী হবে, এই ছিল তাঁর স্বপ্ন।

মঞ্চনাটকে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম
মঞ্চনাটকে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম

শিক্ষক হিসেবে সুনাম ছিল সৈয়দ মহিদুলের। অল্প কথায় সহজে বুঝিয়ে দিতেন, কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। অনেক চলচ্চিত্র পরিচালক মহিদুলের কাছে নিয়ে যেতেন তাঁদের ছবির নায়ক-নায়িকাদের প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্য। মহিদুলের ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ, অভিনেত্রী আফসানা মিমি, অভিনেতা ও পরিচালক গাজী রাকায়েত, অভিনেতা শাহিন আলম, বাসন্তী গোমেজ প্রমুখ।

একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম
একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম

১৯৭৬ সালে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন নিজের নাটকের দল ‘ব্যতিক্রম’। ১৯৭৮ সাল থেকে দলটি কাজ শুরু করে ঢাকায়। নাটকের দল পড়ে থাকত তাঁর বাড়িতেই। যেন ব্যতিক্রমের নাট্যকর্মীরা ছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্য। আর শুধু থিয়েটার করে বেঁচে থাকতে চাওয়া ‘বোকা’ এই মানুষটিকে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তখন। নাটকের লোকেরা তখনো বলতেন, এখনো বলেন, ঢাকায় এমন পাগল দ্বিতীয়টি ছিল না।

গাইবান্ধায় নাট্যকর্মশালায় বক্তৃতা দেন সৈয়দ মহিদুল ইসলাম
গাইবান্ধায় নাট্যকর্মশালায় বক্তৃতা দেন সৈয়দ মহিদুল ইসলাম

সৈয়দ মহিদুল ইসলামকে প্রায়ই দেখা যেত রিকশায় স্টেজ প্রপস্, সেটের মালামাল নিয়ে ঠাসাঠাসি করে বসে যাচ্ছেন মহিলা সমিতির দিকে। মগ্ন-দূরগামী দৃষ্টি। সে সময় অন্য কাউকে চোখে দেখতেন না। ভাবনায় হয়তো থাকত সন্ধ্যার মঞ্চায়ন। তখন তিনি নিজে লিখতেন, বিদেশি নাটক অনুবাদ করতেন, নির্দেশনা দিতেন, স্টেজ সাজাতেন। তাঁর নাটকে অতিকায় সেট থাকত না, অভিনয়টাই সেখানে গুরুত্ব পেত। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশ্বনাটক শুরু করেছিলেন তিনি। নিজে অভিনয় করেছেন টিভি নাটকে, চলচ্চিত্রে, এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণও করেছেন। তাঁর নির্মিত ছবি দুটি ‘আমি কার’, স্বপ্নযাত্রা’। সবকিছুর পরও মহিদুলের হৃদয় পড়ে থাকত মঞ্চে।

টেলিভিশনের সহকর্মীদের সঙ্গে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম
টেলিভিশনের সহকর্মীদের সঙ্গে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম

নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, অভিনেতা, সংগঠক ও নাট্যশিক্ষক সৈয়দ মহিদুল ইসলাম চেয়েছিলেন এই দেশে মঞ্চনাটক হবে একটি স্বতন্ত্র পেশা। তাঁর স্বপ্ন ছিল, দেশের শিল্পীরা অভিনয় করে রোজগার করবেন। সেই টাকায় খাবে, পারবে। তাঁর মেয়ে সৈয়দা নওশীন ইসলাম দিশা জানালেন, অনেক বছর লেগে গেছে। কিন্তু অভিনয়ের টাকায় তিনি এখন চলতে পারেন। দল নিয়ে দেশ-বিদেশে নাটক করতে যেতে পারেন। বাবার একটি কথা দিশার কানে বাজে সব সময়, ‘যেদিন রিহার্সাল রুম মুছতে পারবে, বাথরুম ধুতে পারবে, সেদিনই থিয়েটার করতে পারবে।’ দিশা থিয়েটারের জন্য সব পারেন।

‘সৈয়দ মহিদুল ইসলাম স্মরণ উৎসব ২০১৮’
এ বছর সৈয়দ মহিদুল ইসলামের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ ও নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে তিন দিনের উৎসবের আয়োজন করেছে ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠী। আজ বুধবার থেকে শুক্রবার এ নাট্যোৎসবে দেওয়া হবে ‘সৈয়দ মহিদুল ইসলাম পদক’। এ বছর পদক পাচ্ছেন নাট্যজন আতাউর রহমান। এ তিন দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে সন্ধ্যা সাতটায় মঞ্চস্থ হবে ভিশন থিয়েটারের নাটক ‘নৈশভোজ’, ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠীর ‘পাখি’ এবং নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘গহর বাদশা ও বানেছা পরী’।