বিদায় 'সেক্স সিম্বল'

বার্ট রেনল্ডস (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬—৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
বার্ট রেনল্ডস (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬—৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

গত বৃহস্পতিবার সকালের খবর। ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কিংবদন্তিতুল্য হলিউড অভিনেতা বার্ট রেনল্ডস। হলিউডের ‘সেক্স সিম্বল’ বললে ৮২ বছর বয়সী গোঁফওয়ালা রেনল্ডসের মুখটা ভেসে ওঠে। তাঁকে বলা হয় চলচ্চিত্রে বহু পথের সৃষ্টিকারী।

১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত হলিউড বক্স অফিসে স্রেফ রাজত্ব করেছিলেন তিনি। টানা পাঁচ বছর সর্বোচ্চ আয়কারী তারকার তকমা সেঁটেছিলেন গায়ে। ১৯৭৮ সালে একসঙ্গে তাঁর চারটা ছবি চলেছে হলে। মার্কিন মুলুকে সে এক বিরল ঘটনা বটে। ডেলিভারেন্স, দ্য লংগেস্ট ইয়ার্ড স্মোকি অ্যান্ড দ্য ব্যান্ডিট-এর মতো হলিউডের ‘ট্রেন্ড সেটকারী’ চলচ্চিত্র রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তাঁর ছবি মানেই যেন যতটা সম্ভব তার পুরোটাই দর্শকের আনন্দ আর উপভোগ।

পর্দার বাইরের জীবনও দর্শকের কম আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকেনি তাঁর জীবদ্দশায়। যেসব হাই প্রোফাইল নায়িকার সঙ্গে প্রেম করেছিলেন, সেসব নিয়ে কেচ্ছা-গুঞ্জন সত্তর-আশির দশকে দেদার বিক্রির কারণ হয়েছে চলচ্চিত্র আর লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনগুলোর। তাঁর বিবাহবিচ্ছেদকে বলা হয়েছে হলিউডের সর্বকালের অন্যতম ‘হাই প্রোফাইল ডিভোর্স’।

দর্শকের বিনোদনই রেনল্ডসের জীবনের শাশ্বত আরাধ্য ছিল। প্রথাগত চলচ্চিত্র পুরস্কারের ধার ধেরেছেন তিনি কমই। কিছুটা বিরতির পর নতুন প্রজন্মের কাছে বার্ট ধরা দিলেন নতুন বিস্ময়ে বুগি নাইটস (১৯৯৭) চলচ্চিত্রে। অথচ এই পর্নো ছবির পরিচালক জ্যাক হর্নারের চরিত্র ১০ বার ফিরিয়ে দেন পরিচালককে। ১১তম বারে রাজি যখন হলেন, তাঁর অনবদ্য অভিনয় এনে দিল গোল্ডেন গ্লোব–এ সেরা পার্শ্বচরিত্র অভিনেতার পুরস্কার। অথচ এই ছবিতে পর্দায় প্রথমবার নিজেকে দেখে এতই রেগে গিয়েছিলেন যে তাঁর এজেন্টকে বরখাস্ত পর্যন্ত করেছিলেন। তাঁর ছেড়ে দেওয়া ছবি করে শিকে ছিঁড়েছে হ্যারিসন ফোর্ড, জ্যাক নিকোলসন ও ব্রুস উইলিসের মতো তারকার। নিকোলসন তো ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কুক্কুস নেস্ট ছবিতে তাঁর স্থলে অভিনয় করে অস্কারও বাগিয়ে নিয়েছেন।

স্মোকি অ্যান্ড দ্য ব্যান্ডিটে বার্ট রেনল্ডস ও স্যালি ফিল্ড। দুবারের অস্কারজয়ী স্যালির সঙ্গে পাঁচ বছরের প্রেম তাঁর জীবনের সেরা বলে জানিয়েছিলেন রেনল্ডস। স্যালি তাঁর মৃত্যুর পর বলেছেন, ‘যত দিন বাঁচব, বার্ট থাকবে আমার হৃদয়ে।’
স্মোকি অ্যান্ড দ্য ব্যান্ডিটে বার্ট রেনল্ডস ও স্যালি ফিল্ড। দুবারের অস্কারজয়ী স্যালির সঙ্গে পাঁচ বছরের প্রেম তাঁর জীবনের সেরা বলে জানিয়েছিলেন রেনল্ডস। স্যালি তাঁর মৃত্যুর পর বলেছেন, ‘যত দিন বাঁচব, বার্ট থাকবে আমার হৃদয়ে।’

তাঁর ছবি ডেলিভারেন্স তিনটি অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিল। সে ছবিতে ১০ মিনিটের কর্তনবিহীন ধর্ষণ দৃশ্যে অবশ্য আলোচনা-সমালোচনা দুটোই জুটেছিল। দুর্ভাগ্য সেবার গডফাদারও মনোনয়ন পায়। অথচ এই গডফাদার-এর প্রধান চরিত্র মাইকেল করিলিওনের চরিত্রটা তাঁকেই অফার করা হয়েছিল। সেই অফার ফিরিয়ে দিয়ে অবশ্য আফসোস করেননি কখনো। হলিউডপাড়ায় গুঞ্জন ছিল, বার্ট এলে মারলোন ব্র্যান্ডো চলে যাবেন ছবি ছেড়ে।

রেনল্ডস লিখেছিলেন, ‘আমার একটা ছবির কথা টাইম ক্যাপসুলে রেখে দিতে বললে আমি ডেলিভারেন্স-এর কথাই বলব। আমি জানি না এটাই আমার জীবনের সেরা অভিনয় ছিল কি না। কিন্তু এটি নিশ্চিত, আমার জীবনের সেরা ছবি ছিল। এই ছবি প্রমাণ করেছিল, আমি অভিনয় করতে পারি। সেটা শুধু দর্শকের সামনে নয়, আমার নিজের সঙ্গেও।’

কিছুটা মনে হয় খ্যাপাটেও ছিলেন রেনল্ডস। সে সময় জেমস বন্ডের মতো চরিত্র ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শুধু দর্শকের কথা ভেবে। ভাবলেন, একজন আমেরিকানকে দর্শক জিরো জিরো সেভেন মেনে নেবেন না। সে নিয়ে তাঁর ভক্তদের আক্ষেপ কম নয়! আফসোস অবশ্য তাঁরও একবার হয়েছিল। তবে বার্ট ছবিটা দেখে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, চরিত্রটা তিনি করলে আরও ভালো হতো। বার্ট বলেছিলেন, ‘জীবনকে আমি যা উপভোগ করেছি, আর কেউ তা পারেনি।’ পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর এই কথাকে আপ্তবাক্য মেনেছে।

১৯৭২ সালের এপ্রিল সংখ্যায় ফ্যাশন সাময়িকী কসমোপলিটন তাঁর নগ্ন ছবি সেন্টার ফোল্ড করে ছাপে। ম্যাগাজিনটির প্রথম পুরুষ সেন্টার ফোল্ড হন তিনি। তাতে লেখা ছিল ‘লোমশ পুরুষের প্রতিমূর্তি’। কসমোপলিটন-এর ওই সংখ্যা তাদের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রীত সংখ্যা হয়ে ইতিহাস গড়ে। এর সাত বছর পর প্লেবয় ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদও হয়েছিলেন। তখনো একজন পুরুষ হিসেবে বিরল রেকর্ড করেছিলেন। মাত্র দ্বিতীয় ঘটনা ছিল সাময়িকীটির জন্য। তাঁর গোঁফ তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই সমান কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিল।

বার্ট রেনল্ডসের মতে, ‘সেরা অভিনয় হলো যা দেখতে একদম সহজ মনে হয়, সেটি করা।’ সমালোচকেরা সে সময় তাঁকে মূল্যায়ন করতে ভুল করলেও হলিউড ক্ল্যাসিকে উঠে গেছেন রেনল্ডস বহু আগেই। কিছুদিন পরই কুয়েন্টিন টারান্টিনোর ওয়ানস আপন আ টাইম ইন হলিউড-এর শুটিং শুরু করবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সে ছবিতে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও আর ব্র্যাড পিটের মতো হালের শীর্ষ তারকা বার্টের সঙ্গে পর্দা ভাগ করার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। কিন্তু তা হলো কই? তার আগেই চলে গেলেন চিরতরে না ফেরার দেশে।

বিপ্লব কুমার রায়

দ্য হলিউড রিপোটার, ভ্যানিটি ফেয়ার, ভ্যারাইটি, এবিসি, সিএনএন ও গার্ডিয়ান অবলম্বনে