একটা কষ্ট আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়

অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো
অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো
>চট্টগ্রামে বেড়ে উঠলেও অঞ্জু ঘোষের জন্ম ফরিদপুরে। অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে তাঁর সিনেমায় অভিনয় শুরু। প্রথম অভিনীত সিনেমা তমিজ উদ্দিন রিজভীর ‘আশীর্বাদ’। তবে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’। গত শতকের আশির দশক থেকে অভিনয়জীবন শুরু করা অঞ্জু ঘোষ ১৯৯৮ সালে যখন দেশ ছাড়েন, তত দিনে অভিনয় করেছেন তিন শতাধিক ছবিতে। দুই দশক পর ঢাকায় এসে অতিথি হয়েছেন পরিচালক সাইদুর রহমানের বাসাবোর বাসায়। গত সোমবার দুপুরে সেই বাসায় বসে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশি সিনেমার একসময়ের আলোচিত এই নায়িকা। দেশত্যাগের কারণ নিয়ে কথা শুরু হয়ে গান, সহশিল্পী, ব্যক্তিজীবন, কলকাতার এখনকার জীবনসহ অনেক বিষয় নিয়েই কথা হয়।


বিশ বছর পর দেশে এলেন। আসার কারণ কী?
পরিচালক সাঈদ ভাই (সাঈদুর রহমান) আমার খুব কাছের একজন বড় ভাই। তাঁর উৎসাহে আমার আসা। একই সঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ভূমিকাও ছিল। সব মিলিয়ে আসা হয়ে গেল।

চিত্রনায়ক ওয়াসিম থেকে শুরু করে ইলিয়াস কাঞ্চন—অনেকের সঙ্গে সিনেমায় জুটি হয়েছেন। জুটি হিসেবে কার সঙ্গে অভিনয় করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন?
ওয়াসিম ভাই আমার চেয়ে অনেক আগে সিনেমায় এসেছেন। তাঁকে আমি পেয়েছি একেবারে শেষ দিকে। প্রত্যেক শিল্পী যাঁর যাঁর ভূমিকায় ভালো অভিনয় করতে চায়। বাকিটা দর্শকের ওপর। জুটির বিষয় আসলে আমাকে ভাবলে হবে না, দর্শক জুটি তৈরি করে। ছোট-বড় সবার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। এখনো যদি কাজ করি, তাহলে দেখা যাবে নতুনদের সঙ্গে কাজ করা হবে। তবে কাঞ্চনের সঙ্গে আমার অনেক ছবি হয়েছে। আরও অভিনয় করেছি জাফর ইকবাল, রাজ্জাক ভাই, শাবানা ম্যাডাম, রোজিনা ম্যাডামের সঙ্গে। স্বাচ্ছন্দ্যবোধের ব্যাপারটা পুরোপুরি দর্শকের ওপর নির্ভর করবে, এটাতে আমার কোনো হাত নেই।

আপনি কি আপনার দর্শকদের সঙ্গে ভাগ করতে চাইচেন না অথবা সহশিল্পীদের কাউকে কষ্ট দিতে চাইছেন না?
এটা তেমন কিছু না। ফিল্ম দুনিয়াটা ওপরওয়ালার খেলা। আমি অথবা আরেকজন জোর করে কিছু করতে চাইলেও করতে সম্ভব না।

পর্দার বাইরে কার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল?
সবার সঙ্গে আমাদের আন্তরিকতা ছিল। বাংলাদেশ থেকে আমি ভারতে গিয়েও কাজ করেছি। ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ রেকর্ড ব্রেক করেছে। দর্শক যাকে বেশি চাইবে, তার বাইরে আমাদের কিছু বলার নেই। আমরা দর্শকের জন্য ট্রিটমেন্ট হিসেবে কাজ করি।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো


অনেকের সঙ্গে ছবিতে জুটি হয়েছেন। দর্শক কোন জুটিকে গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়েছে?
দেশ-বিদেশ মিলিয়ে তো অনেক কাজ করছি। আলাদা করে একজন হিরোর কথা বলতে চাই না।

আপনার কণ্ঠে ‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা’র মতো অনেক জনপ্রিয় গান শ্রোতারা শুনেছে। আর কোনো গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন?
এই গানটা কিন্তু আমার গাওয়া প্রথম গান না। তবে মুক্তি পেয়েছে আগে। আর সবচেয়ে বেশি হিট হয়েছে এই গান। সিনেমায় আরও গান গেয়েছি। কাজী হায়াতের ‘আইন আদালত’ ছবিতে গান গেয়েছি।

গানের চর্চা ছোটবেলা থেকেই ছিল?
ছোটবেলা থেকেই আমি গুনগুন করে গান গাইতাম। গানে বেশ আগ্রহ ছিল।

‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা’ গানটি গাওয়ার প্রস্তাব কে দিয়েছিলেন?
শুটিংয়ে সময় আমরা এমনিতে সেটের মধ্যে গুনগুন করে গাইতে থাকি। একদিন সুবল দা (সুবল দাস) বললেন, অঞ্জু, গান গাইতে হবে। তখন অন্য ছবিতে একটা গান গাওয়ার পরিকল্পনা চলছিল। এরপর ভাবলাম, গেয়ে দেখি। একদম খেলার ছলে গানটি গাওয়া।

ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো
ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো


গাওয়ার সময় মনে হয়েছিল গানটা জনপ্রিয় হবে?
তেমন কিছুই মনে হয়নি। আমার তো মনে হয়েছে, গাইতেই পারিনি। এবার যখন ঢাকায় বিমানবন্দরে নামলাম, আমাকে দেখে অনেকে গাইছিল, ‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা’ গানটি। সবাই এতটা খুশি। একটা ছবি তো ইতিহাস হয়ে আছে। আমি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর ও সংগীতে প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দিই। এরপর সুবল দাস, আলাউদ্দীন আলীর সুরেও গান গেয়েছি।

অডিও অ্যালবাম বের হয়েছিল?
আমার দুটো অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। এখন অবশ্য নাম মনে পড়ছে না।

গানে অনুপ্রেরণা কার ছিল?
আমি তো গান ভালো গাইতে পারি না। তবে আমি কিন্তু সংগীত পরিচালনাও করেছি। ছোটবেলায় আমি আর ভাই নিজেদের কথা রেকর্ড করতাম। এরপর শুনতাম, নিজেদের কথা কেমন লাগে। ভাই ভিডিও করত। গুনগুন করে গাইতাম। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি দুর্বলতা ছিল। এসরাজ শিখতাম। ছোটবেলায় মানবেন্দ্র বড়ুয়া আমাকে এসরাজ শিখিয়েছেন। চট্টগ্রামের খুব পরিচিত একজন শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদ ছিলেন তিনি।

আপনার সংগীত পরিচালনায় কারা কণ্ঠ দিয়েছেন?
রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন ও এন্ড্রু কিশোর। আবার গানে আমার সংগীতের প্রেরণাও ছিলেন তাঁরা। তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি করো, তুমি করো।’ সংগীত পরিচালক হওয়ার হাস্যকর ঘটনাও আছে।

যেমন?
আমি তখন অভিনয়ে খুবই ব্যস্ত। উত্তরায় থাকতাম। আমার নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অঞ্জু কথাচিত্রের ‘নিষ্পত্তি’ ছবির শুটিং ছিল। এই ছবিতে আমি আর ইলিয়াস কাঞ্চন জুটি হয়েছিলাম। এই ছবির কাহিনি ছিল এ টি এম শামসুজ্জামানের। যে শিফটে আমাদের ছবির গান রেকর্ড হওয়ার কথা ছিল, সেটা বদলে গিয়ে অন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের গান রেকর্ডিং হচ্ছিল। কথাটা আমার কানে আসে। অথচ পরদিন সকালে আমার গানের শুটিং। তিন দিন পর আবার আমি বাইরে চলে যাব। সিদ্ধান্ত হলো, পরদিন সকালে আমি স্টুডিওতে শিফট নেব, গান রেকর্ডিং হবে আর সংগীত পরিচালনা করব আমি। আমাকে তখন এ কাজে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন ফরিদ আহমেদ।

আপনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ছবিতে এসেছেন। ছবিতে অভিনয়ের জন্য কেন আগ্রহী হলেন?
ছবিতে অভিনয়ের আগ্রহ আমার ছিল না। তখন কৃষ্ণকুমারী স্কুলে পড়তাম। ওখানে বার্ষিক বড় অনুষ্ঠান হতো। সেখানে আমাদের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পরিবেশনায় অংশ নিই। তখন বন্ধুদের অনেকে বলত, আমি সিনেমা করলে ভালো করব। কিন্তু জানি না, আমার মধ্যে সিনেমা করার কী আছে। নাচ খুব একটা ভালো পারতাম না। সবই অল্প অল্প করতাম। রবীন্দ্রসংগীতে নৃত্যনাট্য করতাম। হালকা নাচ। এরপর আর পড়াশোনা করা হয়নি।

ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো
ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। ছবি: প্রথম আলো


আপনার জন্ম চট্টগ্রামের কোথায়?
আমার জন্ম কিন্তু চট্টগ্রামে নয়, ফরিদপুরে। তবে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে।

আপনার প্রথম সিনেমা ‘সওদাগর’?
না, আমার অভিনয় করা প্রথম সিনেমা ‘আশীর্বাদ’, পরিচালক তমিজ উদ্দিন রিজভী। আশির দশকের শুরুতে। তবে মুক্তি পায় এফ কবীর চৌধুরী ‘সওদাগর’। এখন পর্যন্ত সর্বশেষ শুটিং করা ছবি সাইদুর রহমানের ‘নেশা’।

শুনেছি আপনি সাড়ে তিন শ ছবিতে অভিনয় করেছেন। এসব ছবি আপনাকে এনে দিয়েছে জনপ্রিয়তা। নায়ক-নায়িকাদের সাফল্যের পেছনে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কারও ভূমিকা থাকে। আপনার সাফল্যের পেছনের মানুষটি কে?
আমি যখন চলচ্চিত্রে পা রাখি, তখন একটা সংবাদের হেডিং ছিল এ রকম, ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’। স্কুলে গেলেও খুব হাসাহাসি। চলচ্চিত্রে নাম লেখানোর পর আমার মধ্যে একটা বিষয় কাজ করত, যা দেখাবে, তা আমাকে পারতে হবে। একটা ছবির জন্য চট্টগ্রাম থেকে আমার ঢাকায় আসা। কিন্তু দুই-তিন দিনে ১৪টা ছবিতে সাইন করেছি। হাবিবুর রহমান খান, সুভাষ দত্ত, সাংবাদিকেরাও চেয়েছিলেন আমি চলচ্চিত্রে নিয়মিত হই। দর্শক আর সাংবাদিকদের কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। আমি তখন নতুন, গুছিয়ে কথা বলা, কোন কথা বললে ভালো হবে, এটা সাংবাদিক বন্ধুরা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। নানা বিষয়ে পরামর্শ পেয়েছি। তবে বাইরে থেকে মা সহযোগিতা করেছেন। সবদিক তিনি খেয়াল রাখতেন।

শিল্পী তৈরির পেছনে পরিচালক আর প্রযোজকদের ভূমিকা থাকে।
সে সময়ে যাঁরা কাজ করেছেন, সবাই গাইড করেছেন। কারও থেকে কেউ কম নন। তমিজ উদ্দিন রিজভী, এফ চৌধুরী কবির, আলমগীর কুমকুম—একটা বাচ্চাকে যেভাবে হাঁটা-চলা শেখায়, সেভাবে তাঁরা আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়া-আসা করে ছবির শুটিং করতেন?
একদম তাই। তিন চার বছর পর আমি ঢাকায় থিতু হই।

ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ অভিনীত ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ ছবির পোস্টার
ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ অভিনীত ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ ছবির পোস্টার


প্রথম যখন নিজেকে পর্দায় দেখলেন, কেমন লেগেছিল?
প্রথম মুক্তি পায় ‘সওদাগর’। সাংঘাতিক ব্যবসাসফল ছবি। কিন্তু এই ছবিতে অভিনয় করে আমার মন ভরেনি। প্রথম দিকে আরও কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করে আমার একই অবস্থা হয়েছিল। পরের দিকে ধীরে ধীরে ভালো লাগা শুরু হয়। আমি শুধু উন্মাদের মতো কাজ করে গেছি।

আপনি বাণিজ্যিক ছবির সফল নায়িকা। সে তুলনায় সামাজিক গল্পের ছবিতে কম অভিনয় করেছেন। কেন?
বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি সামাজিক গল্পের ছবিতেও অভিনয় করেছি। তবে এটা ঠিক, তা সংখ্যায় কম। আমি কখনোই সময়কে নষ্ট করতে চাইনি।

‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ ছবি নিয়ে মানুষের আগ্রহ এখনো অনেক। এই ছবির সাফল্যের পেছনে রহস্য কী?
সাফল্যের রহস্য আর কিছুই না, এটা মাটির গল্প। এই ছবির গানগুলো মাটির গান, সংলাপগুলো মা-বোন যাঁরা গ্রামগঞ্জে থাকেন, তাঁদের মনের একটা খোরাক। এমন একজন মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তিনি নাকি ২৭০ বার ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ ছবিটি দেখেছেন। আমি সেই লোককে বলছিলাম, কেন মিথ্যে বলছেন? তিনি বলেন, মোটেও মিথ্যা বলছি না। ছবিটি নিয়ে একটা কষ্ট আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

কী সেই কষ্ট?
এক জীবনে এত ছবিতে অভিনয় করেছি, যাঁর সঙ্গেই দেখা হয়, শুধু এই একটা ছবি ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’র কথা বলে।

কলকাতায় এখন আপনার সময় কীভাবে কাটছে?
মা মারা যাওয়ার পর ছুটি কাটাচ্ছি। আমি তো বাবাকেও হারিয়েছি। সবাই। আমার একটুও মনে হয় না, সময় কাটছে না। তবে মাকে খুঁজছি আমি। বাবাও মারা গেছেন। কলকাতার ঘরবাড়িও দেখাশোনার কাজ আছে, সেসব দেখাশোনা করতে হয়। বাগান করা পছন্দ করি।