বিটলস-পাগল এক রুশের কথা

বিটলসের পল ম্যাককার্টনির প্রতিকৃতির সঙ্গে কোলিয়া ভাসিন। সম্প্রতি মারা গেছেন তিনি
বিটলসের পল ম্যাককার্টনির প্রতিকৃতির সঙ্গে কোলিয়া ভাসিন। সম্প্রতি মারা গেছেন তিনি

২৯ আগস্ট বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল খবরটা। কোলিয়া ভাসিন মারা গেছেন।

কে এই কোলিয়া ভাসিন, তা নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামিয়েছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে একটি বাণিজ্যিক ভবনের তিনতলা থেকে পড়ে গিয়ে যে কেউই তো মারা যেতে পারেন। কোলিয়াও হয়তো সে রকম একজন।

কিন্তু কোলিয়া সে রকম একজন হলে এ লেখাটি লিখতে হতো না। কোলিয়া ভাসিন তাঁর বাড়িটাকে বানিয়েছিলেন বিটলস মিউজিয়াম। স্বপ্ন দেখেছেন জন লেননের নামে একটি কলামন্দির তৈরি করার। শান্তি, ভালোবাসা আর সংগীতে ভরা থাকবে সে মন্দির। আর এ জন্য দ্বারে দ্বারে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন। কিন্তু কেউই তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। সেই কষ্ট বুকে নিয়েই হয়তো লাফ দিয়েছেন তিনি, অন্তত স্থানীয় পত্রিকা মনে করে ভাসিন আত্মহত্যা করেছেন।

কোলিয়া ভাসিনের সংগ্রামের বিষয়টি বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে সোভিয়েত যুগে। সে সময় সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠছিল দেশটি। পশ্চিমা সবকিছু বর্জন করা হচ্ছিল। সে সূত্রে ব্রিটেনের ছোকরা চতুষ্টয়ের (জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, জর্জ হ্যারিসন, রিংগো স্টার) বিটলসও নিষিদ্ধ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। বলা হতো, এ হলো পশ্চিমা বুর্জোয়া সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি সোভিয়েত নাগরিকের জীবনের চলার পথকে কলুষিত করে তুলবে। কোলিয়া ভাসিন বা তাঁর মতো সংগীতপ্রেমী তরুণেরা লৌহ যবনিকার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নেতা বা গোয়েন্দাদের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করেই শুনেছেন বিটলসের গান। সেন্ট পিটার্সবার্গে নিজের বাড়িটিকে ভাসিন পরিণত করেছেন বিটলস মিউজিয়ামে। বাড়িটি ছিল পুশকিনস্কায়া ১০।

ভাসিনের বন্ধু ইউরি রিবাকভ মিউজিয়ামের ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘কোলিয়ার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল সেন্ট পিটাসবার্গে জন লেননকে উৎসর্গ করে ভালোবাসা, শান্তি ও সংগীতের একটি মন্দির স্থাপন করবেন। পিরিস্ত্রোইকা চলাকালে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সে রকম একটি জায়গা তাঁকে দেওয়া হবে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় প্রশাসন, কেউই আর ভাসিনের স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামায়নি।

ভাসিনকে নিয়ে কয়েকচ্ছত্র:
সেন্ট পিটার্সবার্গের নাম তখন ছিল লেনিনগ্রাদ। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সে শহরের ফিনল্যান্ড স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ভাসিন। একজন পুলিশ তাঁকে থামাল। ভাসিনের মাথায় তখন বাবরি চুল। পুলিশ বলল, ‘তোমাকে দেখে সোভিয়েত নাগরিক বলে মনে হচ্ছে না!’

এরপর পুলিশ ভাসিনের চুল ধরে টানতে লাগল। যন্ত্রণা হচ্ছিল খুব। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। কিন্তু ভাসিন শক্ত থাকলেন। জড়ো হওয়া মানুষ আমোদে হাসতে লাগল। ভাসিন এর প্রতিবাদ করেননি। করলে তাঁকে যেতে হতো জেলখানায় কয়েদ খাটতে।

বিটলসকে ভালোবাসার জন্য এই ছিল ভাসিনের প্রাপ্তি। এ ব্যাপারে ভাসিন যা বলেছেন, তা-ও স্মরণযোগ্য, ‘বিটলসকে ভালোবেসেছি বলেই আমি কয়েকবার জেল খেটেছি। আমাদের বলা হতো বিটলসকে ভালোবেসে আমরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছি। পশ্চিমা প্রচারণায় গা ভাসিয়েছি। আমরা যারা বিটলস ভালোবাসতাম, তারা আমাদের মতো করে মানুষের শ্রেণিকরণ করে নিতাম। যারা বিটলস সম্পর্কে খারাপ কথা বলত, তাদের আমরা নিকৃষ্ট ধরনের মানুষ মনে করতাম। তিনি শিক্ষক হোন, কর্তৃপক্ষের কেউ হোন, কিংবা হোন বাবা-মা, তাতে কিছু আসে যায় না। বিটলসের বিপক্ষে যারা, তারা সবাই ইডিয়ট।’

বিটলসের লাইভ পিস ইন টরান্টো ১৯৬৯ অ্যালবামটির অরিজিনাল কপি ছিল ভাসিনের কাছে। তাতে ছিল খোদ জন লেননের অটোগ্রাফ! এ নিয়ে গর্ব ছিল তাঁর।

ঘটনাটা বলি। ১৯৭০ সালে জন লেননের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কোলিয়া ভাসিন একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন শিল্পীকে। সে সময় হাজার হাজার চিঠি আর টেলিগ্রামের ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারত ভাসিনের টেলিগ্রাম। কিন্তু টেলিগ্রামটি পড়লেন লেনন, নিজের সই করা অ্যালবাম পাঠিয়ে দিলেন ভক্তের কাছে। এখনো অনেকে মজা করে বলে, সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাসিনই একমাত্র মানুষ, যার সঙ্গে জন লেননের চিঠির আদান-প্রদান হয়েছে!

১৯৮৯ সাল থেকে ভাসিন ঘুরে বেড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য। বিটলসের প্রথম ম্যানেজার অ্যালেন উইলিয়ামসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। অ্যালেন এরপর রাশিয়ায় এসেছেন, বিটলসের জন্মদিন উদ্যাপনও করেছেন।

১৯৯০ সাল থেকে ভাসিন চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেন্ট পিটার্সবার্গে জন লেননের নামে উৎসর্গীকৃত কলামন্দির প্রতিষ্ঠার। অনেকের কাছে কিছুটা উদ্ভট ঠেকেছিল ভাবনাটা। কিন্তু জনসমর্থন ছিল বলে স্মলেনস্কির পামে ভাসিলিয়েভস্কি দ্বীপে একটা জায়গাও দিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু কলামন্দির তৈরি করার খরচ বহন করতে বলা হয়েছিল ভাসিনকে। নিজের বাড়িতে বিটলস মিউজিয়াম করে সেখানে সাহায্য তহবিলও গঠন করেছিলেন ভাসিন। কিন্তু তাতে মন্দির গড়ার কাজ শেষ হয়নি।

১৯৪৫ সালের ২৪ আগস্ট জন্মেছিলেন এই বিটলস-পাগল মানুষটি। মারা যান ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট।