মান্টো আমাকে আধা কিলো অপরাধবোধ দিয়ে গেছেন

সাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর চরিত্রে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী
সাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর চরিত্রে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী
>সারা দিনের খাবার বলতে বিস্কুট আর রাস্তার কলের জল। দীর্ঘ ১২ বছর এভাবেই সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। হার মানেননি নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। তিনি মানেন, অভিনয়সত্তা নিয়ে তাঁর জন্ম। আজও নিজেই নিজের দিকে কঠিনতম চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দেন। এবার তাঁকে দেখা যাবে উর্দু ভাষার প্রগতিশীল লেখক সাদত হাসান মান্টোর চরিত্রে। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধি দেবারতি ভট্টাচার্য

প্রশ্ন: শুনেছি, বায়োপিক করার সময় চরিত্রটি নিয়ে আপনি অনেক গবেষণা করেন। ‘মান্টো’র ক্ষেত্রেও তা-ই করেছেন?

উত্তর: এ ক্ষেত্রে পরিচালক নন্দিতা দাস পাঁচ-ছয় বছর ধরে মান্টোকে নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। মান্টোর মেয়েদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আশপাশের আরও মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি নিজের মতো করে মান্টোকে নিয়ে কিছু অনুসন্ধান করেছি। তবে গুগলে খোঁজ করে মান্টোকে জানা যাবে না। তাঁর বিষয়ে পড়ে তাঁর মানসিকতা, চিন্তাভাবনাকে অনুভব করেছি। আর একবার যদি আপনি কারও এসব ব্যাপার বুঝে নেন, তো তাঁকে অনায়াসে ধরে ফেলতে পারবেন। মান্টোর শরীরের ভাষা আমি সেভাবে ধরেছি। তিনি মাটিতে কিংবা চেয়ারে উবু হয়ে বসে লিখতেন। প্রচুর ভিড়ের মধ্যেও লিখতে পারতেন। এভাবেই তাঁর লেখনীতে জন্ম নিয়েছে অসাধারণ কিছু কাহিনি।

প্রশ্ন: লেখিকা ইসমত চুগতাইয়ের সঙ্গে মান্টোর সম্পর্ক ছবিতে কীভাবে এসেছে?

উত্তর: মান্টোর সঙ্গে ইসমতের ভালোবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক ছিল। তাঁরা একের অন্যের কাজকে সম্মান দিতেন, আবার সমালোচনাও করতেন। পরস্পরকে নিয়ে মজা করতেন। দেশভাগের পর মান্টো যখন পাকিস্তানে চলে যান, তখন ইসমত আপা তাঁকে অনেক চিঠি লেখেন। আবার ভারতে ফিরে আসার জন্য অনেক অনুরোধ করেন। এ-ও লেখেন যে তিনি মান্টোর অভাব অনুভব করছেন। কিন্তু মান্টো চিঠির জবাব দেননি। পড়েও দেখেননি। হয়তো মান্টোর কোথাও যন্ত্রণা ছিল। তাই ইসমত আপার চিঠি অবধি তাঁর হাত যেত না।

মান্টোর পর ঠাকরে বায়োপিকে দেখা যাবে নওয়াজকে
মান্টোর পর ঠাকরে বায়োপিকে দেখা যাবে নওয়াজকে

প্রশ্ন: ‘মান্টো’ করার সময় আপনি নাকি মিথ্যে বলা ছেড়ে দিয়েছিলেন?

উত্তর: হ্যাঁ, মান্টো করার সময় আমি একটু বেশি সত্যবাদী হয়ে উঠেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল তখনই মান্টো হতে পারব, যখন নিজে পুরোপুরি সৎ হয়ে উঠব। তা না হলে আমার অভিনয়সত্তার কোনো দিকই আমাকে মান্টো হয়ে উঠতে সাহায্য করবে না। মানুষের চোখ দিয়ে তার অন্তর জানা যায়। অন্তর থেকে সৎ থাকলে চোখেই ধরা পড়বে মান্টোর সততা। তাই মান্টো হয়ে ওঠার জন্য সৎ হয়ে ওঠা খুব জরুরি ছিল।

প্রশ্ন: নওয়াজুদ্দিনের জীবনে মান্টো কতটা প্রভাব ফেলে গেছেন?

উত্তর: একটা চরিত্র থেকে অভিনেতা যেমন অনেক কিছু নেয়, আবার অভিনেতার জীবন থেকে চরিত্রও কিছু নিয়ে যায়। মান্টোর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তবে আমি বলতে পারব না মান্টো আমার জীবন থেকে কী নিয়েছেন। এটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটুকু বলতে পারি, মান্টো আমাকে আধা কিলো অপরাধবোধ দিয়ে গেছেন। আমি যখন মান্টো হয়ে উঠেছিলাম, তখন মিথ্যাকে জীবন থেকে বিসর্জন দিয়েছিলাম। আগে মিথ্যা বললে অপরাধবোধ অতটা তাড়া করত না। কিন্তু মান্টোর পর মিথ্যা বললে হীনমন্যতায় ভুগি। আমার মিথ্যা হয়তো কারও ক্ষতি করেনি। কিন্তু আমি নিজের চোখে ছোট হয়ে গেছি। নিজের প্রতি যেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি।

প্রশ্ন: আপনি বড় ব্যানার দেখে ছবি করেন, না চরিত্র দেখে?

উত্তর: দেখুন, বড় ব্যানারের ছবি করতে হয় নিজের পরিচিতি গড়তে। তাতে ছোট ছবিগুলোর লাভ। আমি বজরঙ্গি ভাইজান করেছি কবির খানের জন্য। নিউইয়র্ক ছবিতে ছোট একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তাঁর পরিচালনার ওপর আমার আস্থা ছিল। আর সালমান খানও অন্যতম কারণ। সালমানের ছবি মানেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো। তাই অনেক সময় ব্যানার একটা ব্যাপার। তবে আমি টাকার জন্য কখনো ছবি করি না। আমি মান্টোর জন্য এক টাকা নিয়েছি। বড় ছবি করি ছোট ছবিতে বিনা পয়সায় কাজ করতে পারব বলে।

মান্টোর পরিচালক নন্দিতা দাসের সঙ্গে ‘মান্টো’ নওয়াজ
মান্টোর পরিচালক নন্দিতা দাসের সঙ্গে ‘মান্টো’ নওয়াজ

প্রশ্ন: ‘মান্টো’র পর ‘ঠাকরে’ বায়োপিকে আপনি। সাদত হাসান মান্টো থেকে বালাসাহেব ঠাকরে হয়ে ওঠা কতটা মুশকিল ছিল?

উত্তর: কোনো ছবি শেষ হওয়ার পর আমি নির্মমভাবে চরিত্রটিকে জীবন-মন থেকে হটিয়ে দিই। মান্টোকে যদি মনের মধ্যে রেখে দিতাম তাহলে কোথাও বালাসাহেব ঠাকরের (হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল শিবসেনা প্রতিষ্ঠাতা) চরিত্রে তার ঝলক দেখা যেত। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করি, তখন তাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। ছবি হয়ে গেলে সেই চরিত্রটাকে ঘৃণা করতে শুরু করি। যেন চরিত্রটি আমার মধ্যে এতটুকুও বেঁচে না থাকে। তার ফলে পরের চরিত্রকে আমি শূন্য থেকে শুরু করতে পারি।

প্রশ্ন: একসময় শিবসেনা ‘বিবেকানন্দ’ ছবিতে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের চরিত্রে মুসলিম নাসিরুদ্দিন শাহকে নেওয়ায় প্রতিবাদ করেছিল। পরে মিঠুন চক্রবর্তী অভিনয় করেন। আজ ‘ঠাকরে’ ছবির মুখ্য চরিত্রে আপনি। এই দ্বিচারিতা কীভাবে দেখেন?

উত্তর: অভিনেতার কোনো জাত বা ধর্ম হয় না। এগুলোর ঊর্ধ্বে তাঁরা। একসময় শিবসেনা হয়তো চায়নি কোনো মুসলিম অভিনেতা হিন্দুর চরিত্রে অভিনয় করুক। কিন্তু আজ হয়তো তাদের মনে পরিবর্তন এসেছে। আজ শিবসেনার সঞ্জয় রাউত (ঠাকরে ছবির প্রযোজক) আমাকে ‘বালাসাহেব’ চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দিয়েছেন। এ জন্য তাঁর প্রশংসা করা উচিত। অভিনেতা হিসেবে আমার স্বাধীনতা আছে যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করার। যতটা সততার সঙ্গে মান্টো করেছি, ততটাই সততার সঙ্গে ঠাকরে করেছি। চরিত্রের সঙ্গে আমি বেইমানি করি না।

প্রশ্ন: প্রয়াত শ্রীদেবীর শেষ ছবি ‘মম’-এ আপনি কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

উত্তর: শ্রীদেবী ম্যাম অভিনেত্রী হিসেবে নিবেদিত ছিলেন। একটা দৃশ্য যদি চার ঘণ্টার হয়, তিনি ততক্ষণ সেটে থাকতেন। এমনকি বিরতি হলেও সেট ছেড়ে যেতেন না। প্রচারণার সময় তাঁর অন্য রূপ দেখি। দুষ্টুমিতে ভরা শ্রীদেবীকে তখন আবিষ্কার করি। তাঁর চোখেমুখে থাকত দুষ্টুমি। ম্যামের চোখ দেখেই বুঝতে পারতাম, এখন দুষ্টুমি করার মুডে আছেন। তিনি খুব সুন্দরভাবে মজা করতে পারতেন।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে আপনার অসংখ্য ভক্ত আছে। কখনো বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছে আছে?

উত্তর: আমি এখনো বাংলাদেশ যাইনি। তবে যাওয়ার খুবই ইচ্ছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বাংলাদেশে আছেন। সেখানে গেলে নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে দেখা করব। কলকাতা, মুম্বাইতে ফারুকীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমাদের মধ্যে যোগাযোগও আছে।