যেখানে হ্যারিসন, লেনন, ডিলান পাশাপাশি

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ–এ হ্যারিসনের হাতে সেই গিটার, ডানে বব ডিলান
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ–এ হ্যারিসনের হাতে সেই গিটার, ডানে বব ডিলান

নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের জনাকীর্ণ এলাকায়ই একটি দোকান আছে, যার নাম হার্ড রক ক্যাফে। প্রথমবার যখন টাইমস স্কয়ারে যাই, তখন এই ক্যাফেতে ঢোকার কথা ভাবিনি। সাহিত্যিক আহমাদ মাযহার সেই ক্যাফেতে ঢুকেছিলেন এবং আবিষ্কার করেছিলেন জর্জ হ্যারিসনের গিটার। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, সেই গিটারটির কথাই বলা হচ্ছে, যেটি হাতে নিয়ে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ অংশ নিয়েছিলেন হ্যারিসন।

ম্যানহাটনে হার্ড রক ক্যাফে
ম্যানহাটনে হার্ড রক ক্যাফে

এই তথ্য জানার পর কে আর বসে থাকে! নিউইয়র্কে এসে প্রথম আকর্ষণই তো ছিল ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন। সেখানে যাওয়ার পর প্রথম মনে পড়েছিল কনসার্টটির কথাই। এরপর মনে পড়েছিল মোহাম্মদ আলী আর জো ফ্রেজিয়ারের সেই ধ্রুপদি মুষ্টিযুদ্ধের কথা। শৈশবের স্মৃতি বলেই কি না, জানি না, এই দুটো ঘটনা মনে গাঢ় ছায়া ফেলেছে।

দুরুদুরু বুকে হার্ড রক ক্যাফেতে ঢুকি। শুরুতেই টি–শার্টসহ নানা পণ্যের সম্ভার। দাম একটু চড়া, তবে যথেষ্ট আরামদায়ক পোশাক। আছে ব্যাগ। কোনো কোনো টি–শার্ট আর ব্যাগে ইংরেজিতে ১৯৭১ লেখা দেখে মনটা দুলে ওঠে! নাহ্‌! ওরা ভোলেনি সেই সালটিকে!

জর্জ লেনন যে গিঢারটি উপহার দিয়েছিলেন বব ডিলানকে
জর্জ লেনন যে গিঢারটি উপহার দিয়েছিলেন বব ডিলানকে

এদিক-ওদিক তাকাই। বিশাল বিশাল গিটার ঝুলছে সিলিংজুড়ে, কিন্তু প্রত্যাশিত গিটারটির দেখা মেলে না। একজন গার্ডকে জিজ্ঞেস করেও ইতিবাচক উত্তর পাই না। সে শুধু বলে, ‘নিচে নেমে দেখুন, ক্যাফের কাছে থাকতে পারে।’ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই বুঝতে পারি, এটা দোকানের ছদ্মবেশে এক জাদুঘর। হ্যাঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি হলুদ রঙের সেই গিটারটা! জর্জ হ্যারিসনের গিটার! মনের পর্দায় ভেসে ওঠে জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান গাইছেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশে—এমন একটি ছবি। হ্যাঁ, এই গিটারটাই তো হ্যারিসনের হাতে! ‘বাংলাদেশ’ গানটাও তো হ্যারিসন গেয়েছিলেন এই কনসার্টে। গিটারটার নিচে লেখা আছে, ‘এটিই জর্জ হ্যারিসনের সেই গিটার (হার্পটন), যেটি ব্যবহৃত হয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশে।’

জর্জ হ্যারিসনের সেই গিটারটি
জর্জ হ্যারিসনের সেই গিটারটি

যেখানে জর্জ হ্যারিসনের গিটার, তা থেকে খানিক দূরেই রয়েছে পল ম্যাকার্টনির গিটার। দুটো গিটারের মাঝে খানিকটা জায়গা, সেখানে প্রদর্শনী হয়। প্রদর্শনীতে চারটি করে বাদ্যযন্ত্র বা তারকার পোশাক-আশাক থাকে। এগুলো পরিবর্তনশীল। কিন্তু হ্যারিসন আর ম্যাকার্টনি স্থির।

এবার চোখ যায় সেই ছোট্ট প্রদর্শনীটির দিকে। চমকে যাই! বিটলসের জন লেননের গিটার! সেখানে আবার লেখা আছে বব ডিলানের নাম। জন লেননের ‘ইমাজিন’ আর বব ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ শোনেনি, পশ্চিমা সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে! তাদের দুজনের নাম একই গিটারের সঙ্গে কেন? বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। কারণ, সেই গিটারের নিচে লেখা আছে বিস্তারিত। এই গিটারটি জন লেননের। তিনি এটি উপহার দিয়েছিলেন বব ডিলানকে, ১৯৬৮ সালে। ডিলান এটি নিজের কাছে রেখেছিলেন ১৯৮০ সালে লেননের মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে জন লেননকে ম্যানহাটনেই তাঁর বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করেছিল তাঁরই মানসিক ভারসাম্যহীন ভক্ত মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান)। এরপর গিটারটি তাঁর বহু বছরের সঙ্গী সেজার ডিয়াজকে দিয়ে দেন ডিলান। কারণ, এই গিটারটি নিহত বন্ধু লেননের সঙ্গে তাঁর অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিত, যা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

ব্যাগে-১৯৭১
ব্যাগে-১৯৭১

হার্ড রক ক্যাফে রক ঘরানার আরও অনেক স্মৃতির আকর। সেগুলোর ছবি তুলতে তুলতে মনে হয়, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, জিমি হেনড্রিকস, কেইথ রিচার্ডসহ আরও যাঁদের স্মৃতি রয়েছে এখানে, তা দেখতে দেখতে রকের ইতিহাসের দুনিয়াটাও বুঝি ঘুরে আসা যায় এক চক্করেই।