এ ছিল মুগ্ধকর অপার বিস্ময়

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নিবেদিত গ্যালিলিও নাটকের একটি দৃশ্যে আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের ও কাওসার চৌধুরী।  ছবি: আবদুস সালাম
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নিবেদিত গ্যালিলিও নাটকের একটি দৃশ্যে আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের ও কাওসার চৌধুরী। ছবি: আবদুস সালাম

সত্তর ও আশির দশককে মনে করিয়ে দিল মহিলা সমিতি। নাটক দেখার জন্য এত মানুষ এসেছে, তা ছিল বিস্ময়কর। নতুন তৈরি করা নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে গতকাল শুক্রবার সমবেত হয়েছিলেন দুই ধরনের মানুষ—একদল মানুষের কাছে টিকিট পাওয়া ছিল হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। অন্য দলে ছিলেন কত যে মানুষ! একটি টিকিটের জন্য মরিয়া হয়ে এর কাছে–ওর কাছে ধরনা দিয়েছেন তাঁরা। শোনা গেল এমন আর্তিও, ‘ঢুকবার সুযোগ দিন শুধু, দাঁড়িয়ে দেখব!’ কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে সময় নষ্ট না করেই আসনপূর্ণ মিলনায়তনে নির্ধারিত সময়ে শুরু হলো নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি।

বেশ কিছুদিন ধরে সংবাদপত্র ও বিভিন্ন চ্যানেলে নাটকটি ছিল আলোচনায়। ১৯৮৮ সালে প্রথম যখন নাটকটি মঞ্চে এসেছিল, তখন এর নির্দেশক ছিলেন মঞ্চনাটকের খ্যাতিমান নির্দেশক ও অভিনেতা আতাউর রহমান। সে সময় নাটকটি ছিল আড়াই ঘণ্টার। দীর্ঘদিন পর ফিরে আসা ‘গ্যালিলিও’র নবীন নির্দেশক পান্থ শাহরিয়ারের হাতে তা হলো দেড় ঘণ্টার। বিরতি ছাড়াই সংগীতের সুরে দৃশ্যবদলের মাধ্যমে এগিয়ে গেল নাটক।

যে আলী যাকেরকে দেখা গেল গ্যালিলিওর ভূমিকায়, কে বলবে তিনি ভীষণ রকম জটিল অসুখকে পেছনে ফেলে এভাবে গ্যালিলিও হয়ে উঠবেন? চার্চের বন্দিদশায় যাওয়ার আগে ও পরের গ্যালিলিও যেন একেবারেই ভিন্ন দুই মানুষ। শক্তিমান অভিনয়শিল্পী যে নিজেকে আড়াল করে চরিত্রের গভীরে ঢুকে দুলিয়ে দিতে পারেন দর্শকহৃদয়, তা দেখার সৌভাগ্য হলো দর্শকদের।

কমবেশি ২০ বছর পর মঞ্চে উঠলেন আসাদুজ্জামান নূর। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী তিনি। নাটকে তিনি তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বিশেষভাবে তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হতে হলো পোপের চরিত্রে। যখন তাঁকে একের পর এক পোপের পোশাক পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন তিনি নরম মানুষ থেকে কীভাবে শক্তিশালী স্বৈরাচার হয়ে উঠলেন, তা ছিল দেখার মতো।

বের্টোল্ড ব্রেশ্টের লেখা দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি নাটকটির অনুবাদ করেছেন আব্দুস সেলিম। বিজ্ঞানের নানা ধরনের আবিষ্কারে নিমজ্জিত মানুষ এই গ্যালিলিও। তাঁর কাজ শুধু তখন পর্যন্তই রাষ্ট্র ও চার্চের অনুমোদন পায়, যতক্ষণ তা তাদের স্বার্থে ও প্রচলিত বিশ্বাসে আঘাত না হানে। গ্যালিলিও তাঁর শিষ্যদের নিয়ে মেতে থাকেন আবিষ্কারের নেশায়। যখন তিনি প্রচলিত বিশ্বাস—সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে—এই কথার বিপরীতে বলেন, সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তখনই চার্চ খেপে ওঠে। ভয়ভীতি দেখানোর মধ্য দিয়ে তাঁকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেওয়া হয়, এত দিন তিনি যা বলেছেন, তা সত্য নয়। এরপর চার্চের আনুকূল্যেই বেঁচে থাকেন তিনি। কিন্তু ওই বন্দিদশাতেই রাত জেগে লিখে গেছেন এবং তা নকল করে লুকিয়ে রেখেছেন গ্লোবের মধ্যে। প্রিয় ছাত্র আন্দ্রিয়া সার্তির হাতে তা পাচার করে দেন দেশের বাইরে। ‘ডিসকোর্সি’ নামের সে লেখায় তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন, ছিল তারই বয়ান।

মধ্যযুগের কিংবা রেনেসাঁর সময়েও যে সামাজিক ও মানসিক টানাপোড়েন ছিল, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে তা বোঝা যাবে না। এখন অনেক কিছুই প্রমাণিত, তাই যে প্রশ্নগুলো চার শ বা পাঁচ শ বছর আগের পৃথিবীবাসীকে ঘোরতর সংশয় ও সংকটে ফেলত, তা এ সময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। তবু তা আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? বহুদূর এগিয়েও আমরা যে বারবার রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিংস্র থাবার নিচে পড়ে ক্লিষ্ট হচ্ছি, সেই সত্য কি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে? একেবারেই না। গ্যালিলিওর অসহায়ত্বের মাধ্যমে আমরা যেন সেই অসহায়ত্বের বর্তমান রূপটিকেও দেখে ফেলি। বুঝে ফেলি, ক্ষমতাবানেরা শুধু সেই কথাই শুনতে চায়, যা তাদের দেখানো পথ অনুযায়ীই চলবে। যুগের পর যুগ সেটাই চলে আসছে।

পুরোনো অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন কাওসার চৌধুরী, আবদুর রশিদ ও ফারুক আহমেদ। নতুন যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরা বুঝতে দেননি যে এ নাটকে এবারই তাঁরা প্রথম। মুখোশ পরে নাচের দৃশ্যটা আরও ভালোভাবে উপস্থাপন করার দরকার ছিল। তা ছাড়া নাটকটি নিয়ে বলার একটি বাক্যই বলার আছে—এ ছিল মুগ্ধকর অপার বিস্ময়!