গাইতে গাইতে ১৩০ কিলোমিটার

লালনের গান গাইতে গাইতে এভাবে দলটি পাড়ি দিল ১৩০ কিলোমিটার
লালনের গান গাইতে গাইতে এভাবে দলটি পাড়ি দিল ১৩০ কিলোমিটার

বিক্রমপুরের লালন সাঁইজির আখড়া পদ্মহেম ধাম থেকে বেরিয়ে কিছু লোক গান গাইতে গাইতে হাঁটছেন। ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। দেখলেন দূর থেকে একজন লোক ডাকছেন। তিনি একজন গৃহস্থ। দূর থেকেই দলটির গান শুনে বুঝে ফেলেন তাঁরা লালনেরই কোনো ভক্ত। গৃহস্থ এই দলটিকে নিয়ে যান তাঁর নিজ বাড়িতে। আপ্যায়ন করেন নানা ধরনের খাবার দিয়ে।

লালনের গান গাইতে গাইতে এভাবে দলটি পাড়ি দিল ১৩০ কিলোমিটার। পথে মিলেছে লালন –ভক্তদের ভালোবাসা আর আতিথেয়তা। হেঁটে হেঁটে লালনের গান গাওয়ার আয়োজনটির নাম ‘লালন যাত্রা’। লালন–ভক্ত দুটি গানের দল আনন্দনগর ও সহজ আয়োজনটি করে। ৮ অক্টোবর বিকেলে কথা হলো আয়োজন ও তাঁদের ভাবনাগুলো নিয়ে।

দলের সদস্য কবির হোসেন জানালেন লালন যাত্রার শুরুর দিকের কথা। তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে আমরা প্রথম লালন ফকিরের নামে লালন যাত্রা শুরু করি। সাঁইজিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আমরা ঘুরে বেড়াই গ্রামে গ্রামে। নানা অঞ্চলে। শুধু গ্রাম নয়, শহর ও নগরেও ঘুরে বেড়াই সাঁইজির গান নিয়ে।’

কী করেন তাঁরা এই লালন যাত্রায়? জানতে চাওয়া হয়েছিল। একজন সদস্য বললেন, একটি এলাকা ও দিন নির্দিষ্ট করেন প্রথমে। তারপর ওই এলাকার কোনো লালন–ভক্তের মাধ্যমে এলাকাতে কারও উঠোনে বসে গানের আসর। কিংবা রাস্তায় হেঁটে হেঁটেও পরিবেশন করেন লালনের গান। গান শুনে শ্রোতা ও লালন–ভক্তরা যেমন আনন্দ পান, তেমনি আনন্দ লাগে এই শিল্পীদেরও।

এই যাত্রার আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য কী? কবির বলেন, ‘ফকির লালন সাঁইজি আজ থেকে আড়াই শ বছর আগে গ্রামেগঞ্জে মানবতার গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। গানের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার করেছেন। মানুষের মনকে প্রফুল্ল করেছেন। ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও আমরা দেখতাম হেঁটে হেঁটে গান করা হতো। এখন এটা বিলুপ্তপ্রায়। এই কারণে আমরা দুটি গানের দল আনন্দনগর ও সহজ এইভাবে হেঁটে হেঁটে মানুষের কাছে সাঁইজির গান প্রচারের কাজটি শুরু করি।’

এই গান প্রচারে তাঁরা সময়ের হিসাব করেননি। করেছেন পথের হিসাব। কতটা পথ গাইতে গাইতে চললেন লালন–ভক্তরা? একজন উত্তর দিলেন, প্রথমবারের আয়োজনে ১১৬ কিলোমিটার পথ চলেছিলেন গাইতে গাইতে। এরপর কিছুদিনের বিরতি। ৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাঁরা পথ চলেছেন মোট ১৩০ কিলোমিটার। এতে তাঁরা পেরিয়েছেন বেশ কয়েকটি জেলা। শুরুটা হয় মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের লালন শাহ বটতলা পদ্মহেম ধাম থেকে। এরপর নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও ঢাকায় লালন যাত্রা করেন। খুব শিগগির আবারও বের হবেন। লালন শাহের তিরোধান দিবস উপলক্ষে ইচ্ছা আছে কুষ্টিয়া জেলায় ঘুরে ঘুরে গান গাওয়ার। আর এভাবে পুরো বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে গান গাওয়ার ইচ্ছা তাঁদের। যদি সম্ভব হয়, দেশের বাইরেও।

তবে শুধু গান শোনানোই উদ্দেশ্য নয়। লালন সাঁইজির গানকে প্রকৃত সুরে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াও তাঁদের কাজ। একজন সদস্য বলছিলেন, ‘এই অনলাইনের সময়ে অনেকেই লালনের গানকে রিমিক্স করে, ফিউশন করে গাইছেন। তাতে গানের মধ্যে যে প্রাণ থাকে সেটি নষ্ট হয়ে যায়। মাঝে মাঝে সুরও বিকৃত হয়ে যায়। আমরা সাঁইজির মূল গানকে ভক্তদের কাছে, মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই।’

লালন–ভক্তরা অনেকেই ভাবতে পারেন, তাঁরা কোথায় কখন গান করবেন তার কি কোনো হদিস পাওয়া যাবে? তাঁদের বলি, তাঁদের কোনো সময় নিয়ে ভাবনা নেই। যখন যে অঞ্চলে যেতে মনে চাইবে, সে অঞ্চলেই গান করতে চলে যাবেন তাঁরা। আপনার বাড়িতেও হঠাৎ একদিন হাজির হয়ে যেতে পারেন লালনসংগীতের এই বার্তাবাহকেরা।