মা আমাদের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছেন

>

কাজল
কাজল

আর পাঁচজন নায়িকার থেকে কাজল সম্পূর্ণ আলাদা। সবার কাছে তিনি যেন পাশের বাড়ির দুষ্টু মিষ্টি মেয়েটি। ২৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কাজলের ছবির সংখ্যা আহামরি কিছু নয়। তবু সবার মনে জায়গা করে আছেন এই বলিউড সুন্দরী। আগামীকাল মুক্তি পাচ্ছে কাজল অভিনীত ছবি হেলিকপ্টার ইলা। প্রদীপ সরকার পরিচালিত এই ছবিতে তাঁকে দেখা যাবে এক কিশোরের ‘সিঙ্গল মাদার’ হিসেবে। ‘সান এন স্যান্ড’ হোটেলে বলিউডের দাপুটে অভিনেত্রী কাজলের মুখোমুখি প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধি দেবারতি ভট্টাচার্য। এই আড্ডায় ‘নায়িকা’ কাজল নন, ‘মা’ কাজল কথা বললেন।

প্রশ্ন: অনেক দিন পর আবার পর্দায় আসছেন। ‘হেলিকপ্টার ইলা’ ছবিটি নিয়ে কতটা রোমাঞ্চিত?

কাজল: সত্যি বলতে, আমি খুব একটা রোমাঞ্চিত নই। তবে আশা করি দর্শক যেন ছবিটা পছন্দ করেন এবং ছবিটার প্রশংসা করেন। আর অবশ্যই চাই, এই ছবি থেকে বেশি করে অর্থ আয় করতে (সশব্দে হেসে)। হেলিকপ্টার ইলার মতো ছবির সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমি গর্বিত।

প্রশ্ন: ‘হেলিকপ্টার ইলা’ ছবির ইলার সঙ্গে আপনার মায়ের (অভিনেত্রী তনুজা) কতটা মিল খুঁজে পান?

কাজল: আমার মা একদমই ইলার মতো নন। ইলার একদম বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন তিনি। আমার মনে হয়, মায়ের কাছ থেকে ইলার ক্লাস নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আমার মা খুব সুন্দরভাবে জীবনদর্শন বুঝিয়েছেন। তিনি যেটা আমাদের শিখিয়েছেন, সেটা করে দেখিয়েছেন। মা আমাদের স্বাধীনচেতা হতে শিখিয়েছেন, তিনি নিজে সেটা আগে হয়ে দেখিয়েছেন। মা কোনো কিছু শেখানোর আগে সেটা নিজে আগে প্র্যাকটিস করতেন। মা আগে খুব গালাগাল করতেন। তিনি বুঝেছিলেন এটা মোটেই ভালো নয়। তাই সবার আগে তিনি গালাগাল দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করেছিলেন। আর এটাই একটা ভালো শিক্ষকের লক্ষণ।

প্রশ্ন: আপনার সন্তানদের ক্ষেত্রেও কি আপনি মায়ের দেখানো পথে চলেন?

কাজল: আমি আমার মায়ের মতো মেয়েকে সেই সব শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক সময় হয়তো করতে পারি না। কিন্তু চেষ্টা থাকে। আমার মা আমাদের সব সময় আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছেন। মেয়ে বলে তিনি আমাদের কখনো বলেননি যে এই করা উচিত নয় বা এই করা উচিত। মা সব সময় বলেন, মেয়েরা সবকিছু করতে পারে। আর নিজেকে সম্মান করা খুব জরুরি। আমার সন্তানদের মধ্যেও মায়ের শিক্ষার বীজ বপন করার চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন: মা হিসেবে ইলার থেকে আপনি কী কী শিখেছেন?

কাজল: (সশব্দে হেসে) ইলা আমাকে কী কী করা উচিত নয় তা–ই শিখিয়েছে। প্রথমত, সন্তানদের মোবাইল ঘাঁটতে নেই। টিফিন ফেরত নিয়ে এলে তা নিয়ে অযথা অশান্তি করার প্রয়োজন নেই। আসলে একটা বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরও আমরা আমাদের সন্তানদের বাচ্চা হিসেবে দেখি। আমরা কখনোই ভাবি না যে ওরা বড় হয়েছে। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত অনেক সময় ওদের ওপর চাপিয়ে দিই। আমরা জানতে চাই না যে ওরা কী চায়। সন্তানদের জীবনের সিদ্ধান্ত ওদের মতামত না জেনেই আমরা নিয়ে নিই। এই ছবিটা করার পর আমার মনে হয়েছে সন্তানদের একটা সময়ের পর প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে দেখা উচিত। হেলিকপ্টার ইলা ছবিটা দেখার পর আমার মনে হয় বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্কের রসায়ন একটু হলেও বদলাবে।

প্রশ্ন: এই ছবিতে আপনি সিঙ্গল মাদার। এখন ডিভোর্সের সংখ্যা সেই বেড়ে চলেছে। এই সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

কাজল: আমার মতে, বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। যাকে বিয়ে করছি শুধু সে নয়, তার আশপাশের মানুষগুলো ভালো হওয়া জরুরি। সঠিক মানুষটিকে পেতে যদি অনেক সময় লেগে যায়, তবে যাক।

প্রশ্ন: মা হিসেবে আপনি আপনার সন্তানদের থেকে কি কিছু শিখেছেন?

কাজল: আমার দুই সন্তান খুবই বুদ্ধিমান। আমার ছেলেমেয়েরা আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। আমার মেয়ে নিয়াসা আমাকে সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে শিখিয়েছে। দুই বছর আগে নিয়াসা আমাকে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ১৫ মিনিটের একটা ভাষণ দেয়। ও আমাকে বোঝায় যে কেন আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা জরুরি। আমার ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ানোর জন্য নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রয়োজন। বুঝুন, একটা ১৩ বছরের মেয়ের থেকে আমাকে এই সবকিছু শিখতে হয়েছে।

প্রশ্ন: কোথাও মনে হয় না, এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে আপনার অভিনীত ছবির সংখ্যা নেহাতই কম—

কাজল: না, আমার কখনোই তা মনে হয় না। ১৬ বছর বয়সে আমি প্রথম ছবিতে অভিনয় করি। বিয়ে হওয়ার আগে আমি ৮-১০ বছর অভিনয় করে ফেলেছি। তবে বিয়ের পর আমি কাজ কমিয়ে দিয়েছি। আমি সারা জীবন কাজ করতে চাই।

প্রশ্ন: বক্স অফিসের হিট-ফ্লপ আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?

কাজল: একদমই করে না। আমি জানি অনেকেই বলবেন যে তাঁদের কাছে বক্স অফিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার কাছে এসব ম্যাটার করে না। কারণ, আমি অত্যন্ত সততার সঙ্গে কাজ করি। আমার চরিত্রের প্রতি, ছবির প্রতি সব সময় সৎ থাকি। নিজেকে উজাড় করে দিই। তাই বক্স অফিসে ছবিটা চলল কি চলল না, আমি তা নিয়ে ভাবি না।

প্রশ্ন: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রোল হওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন?

কাজল: ট্রোলিং নিয়ে আমার অভিমত, পাঁচটা মানুষ যদি আপনার সম্পর্কে কুমন্তব্য করেন তো পাঁচ হাজার মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন। তাই ভালোটাই মনে রাখা উচিত।

প্রশ্ন:বির পরিচালক প্রদীপ সরকার থেকে সহ–অভিনেতা ঋদ্ধি সেন বাঙালি। সেটে কতটা বাঙালি পরিবেশ ছিল?

কাজল: আমি এত বাঙালি কখনো একসঙ্গে দেখিনি। সেটে সবাই বাংলায় কথা বলছিল। যাঁরা বাংলা বলতে জানতেন না, তাঁরাও বাংলা বলছিলেন। ঋদ্ধি তো কলকাতারই ছেলে। দাদা (প্রদীপ সরকার) সেটে সব সময় বাঙালি পরিবেশ বজায় রাখতেন। আর দাদার এটাই বিশেষত্ব। ছবির সব অভিনেতা বাংলায় কথা বলছিল। সহকারীরা মুম্বাইয়ের হয়েও বাংলা বলছিল। আমরা সেটে বাঙালি নিউ ইয়ার পালন করেছি। প্রচুর বাঙালি খাওয়াদাওয়া হতো।

প্রশ্ন: ঋদ্ধিকে কেমন লাগল?

কাজল: দারুণ অভিনেতা ও। আর ঋদ্ধির বাবা-মায়ের শিক্ষা খুবই ভালো। শুটিংয়ের পর আমরা বসে অনেক কথা বলতাম।

প্রশ্ন: অজয় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি আপনার অভিনীত ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ ছবিটি দেখেননি। এর কি কোনো বিশেষ কারণ?

কাজল: আমি নিজেও জানি না। আমি অনেকবার ওকে দেখতে বলেছি। কিন্তু ও দেখেনি। আর অজয় হিন্দি ছবিটাই কম দেখে।

প্রশ্ন: এই প্রজন্মের অভিনেত্রীদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ কী?

কাজল: এখনকার প্রত্যেক অভিনেত্রী অনেক বেশি নিজেকে প্রস্তুত করে সিনেমার জগতে আসে। এদের ছবি দেখলেই তা বোঝা যায়। আর আমার মনে হয় এরা মায়ের পেট থেকে চুল সোজা করে, আইলাইনার এবং নিখুঁত মেকআপ করে বের হয়েছে। এদের দেখে মনে হয় এরা জন্ম থেকেই ডান্স এবং সোশ্যাল মিডিয়া ক্লাসে যেত। আমি এদের থেকে অনেক কিছু শিখছি। এদের আমার থেকে কিছু শেখার আছে বলে আমার মনে হয় না।

প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় তাঁদের তুলনায় আপনি অনেক বেশি সাধারণ ছিলেন?

কাজল: একদমই তাই। তবে আমি মনে করি আমি শেখার অনেক বেশি সময় পেয়েছি। আসলে তখন মানুষ অভিনেত্রীদের সাজপোশাক নিয়ে এতটা চুলচেরা বিশ্লেষণ করত না। লিপস্টিক লাগিয়েছি কি না, কী পোশাক পরেছি, সে সব নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। এদিক থেকে আমরা খুব ভাগ্যবান ছিলাম। কিন্তু এখন ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে সবকিছু যেন খতিয়ে দেখা হয়।

প্রশ্ন: বলিউডে ছেলেরা বরাবরই মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি পারিশ্রমিক পান। এ ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?

কাজল: আমি মানছি, এই ইন্ডাস্ট্রিতে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বিভাজনরেখা আছে। কিন্তু নায়কেরা একার কাঁধে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটির ছবি দেয়। সালমানের ছবি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে। কিন্তু আজ অবধি কোনো নায়িকা কি পেরেছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা দিতে। তবে আমিও চাই মেয়েদের পারিশ্রমিক যেন বাড়ে।

প্রশ্ন: আপনার ফিটনেস–রহস্য কী?

কাজল: আমি খাওয়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন। জল বেশি পরিমাণে পান করি। আর পর্যাপ্ত ঘুমাই। রাতে লম্বা একটা ঘুম চাই–ই চাই। অনেকে যখন রাতে পার্টিতে ডাকে, আমি বলি দিনের বেলায় পার্টি করতে। রাত ১০টার পর বিছানাটা আমায় ডাকে। আর আপনি যদি নিজেকে ভালোবাসেন, তার প্রতিচ্ছবি আপনার মুখে ফুটে উঠবে।