বলিউডের মুখোশ খসে পড়ছে

তনুশ্রী দত্ত
তনুশ্রী দত্ত

‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ ঝড়ে ধীরে ধীরে নগ্ন হচ্ছে বলিউড। ক্রমশ খসে পড়ছে এক একটা মুখোশ। এত দিন ‘কাস্টিং কাউচের’ দিকে অনেক আঙুল তুলেছেন নির্যাতিতারা। এখন দেখা যাচ্ছে অভিনেতা, লেখক, গায়ক, পরিচালক, প্রযোজক, কোরিওগ্রাফার— সবাই এক একজন মুখোশধারী।

তবে একটাই সুখবর, ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ ক্যাম্পেইনের জেরে ধীরে ধীরে বদল আসছে বলিউডে। ছোট থেকে বড় তারকা—সবাই আজ একজোট হয়ে রুখতে চলেছেন নারীদের প্রতি এই িনপীড়ন। চলচ্চিত্র–দুনিয়ায় মেয়েদের সুরক্ষিত করতে তিনটি বড় চলচ্চিত্র সংস্থা আলাদা সিদ্ধান্ত জারি করেছে। প্রডিউসার গিল্ড অব ইন্ডিয়া, সিনে অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিনটা) এবং দ্য ফেডারেশন অব ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া সিনে এমপ্লয়িজ (এফডব্লিউআইসিই)—এই তিন সংস্থা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে চলেছে। এর সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন আমির খান, ইমরান খান, হৃতিক রোশন, অর্জুন কাপুর, পরিণীতি চোপড়া, ঐশ্বরিয়া রাই, টুইংকেল খান্না, স্বরা ভাস্কর, চিত্রাঙ্গদা সিং, প্রীতি জিনতা, কাজল, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো অভিনেতা–অভিনেত্রীরা। বলিউডের মেগা স্টার অমিতাভ বচ্চন এবার সরব হয়েছেন এই আন্দোলনে। তবে করণ জোহর, অক্ষয় কুমার, সালমান খান, অজয় দেবগনের মতো তারকারা আজও একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি এ বিষয়ে।

প্রায় দুই বছর আগে হলিউডে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ অভিযান শুরু হয়, যার জোয়ারে হলিউডের অনেক ব্যক্তির মুখোশ খুলেছে। তবে সে সময় বলিউডে এ ক্যাম্পেইনে সেভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি। এত দিন পর সেই অভিযানে প্রথম সরব হন বলিউড অভিনেত্রী, সাবেক ভারতসুন্দরী তনুশ্রী দত্ত। তিনিই প্রথম সোচ্চার হন তাঁর সঙ্গে হওয়া যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে। তনুশ্রীর অভিযোগের আঙুল ছিল নানা পাটেকরের মতো একজন প্রভাবশালী অভিনেতার বিরুদ্ধে। তনুশ্রীর এই প্রতিবাদের আগুন বলিউডে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তনুশ্রী ভেবেছিলেন বলিউডে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ অভিযানের প্রসার হওয়া অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। সবাই তনুশ্রীর এই সাহসের জন্য তাঁকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। তাঁরই পথ ধরে বিটাউনের নির্যাতিতারা আজ তাঁদের অতীতের সেই কদর্য দিনটির কথা প্রকাশ্যে বলছেন।

১০ বছর আগে হর্ন ওকে প্লিজ ছবির সেটে তনুশ্রী দত্তকে যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয়। নানা পাটেকর যৌন হেনস্তা করেন বলে অভিযোগ। তবে তনুশ্রীর অভিযোগের আঙুল আরও অনেকের বিরুদ্ধে উঠেছিল। হর্ন ওকে প্লিজ ছবির পরিচালক রাকেশ সারঙ্গ, প্রযোজক শমী সিদ্দিকী এবং কোরিওগ্রাফার গণেশ আচার্য তনুশ্রীকে উৎপীড়ন করেন বলে তাঁর অভিযোগ। এই বলিউড অভিনেত্রী তখনই তাঁর সঙ্গে হওয়া এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি কাউকে পাশে পাননি। এমনকি শিল্পীদের সংগঠন সিনটাও তনুশ্রীর একটি কথা শুনতে রাজি ছিল না। পুলিশও সেদিন কোনো অভিযোগ নেয়নি। মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার কর্মীরা হামলা চালিয়েছিলেন তনুশ্রীর বাড়িতে ও গাড়িতে। রীতিমতো ভয় পেয়ে ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়ে দেশ ছাড়েন তনুশ্রী। বিয়ে থা করে আমেরিকায় সুখে সংসার করছিলেন সাবেক এই ভারতসুন্দরী। কিন্তু ১০ বছর আগের সেই ক্ষত আজও তাঁর শুকায়নি। তাই আবার দেশে ফিরে নানা পাটেকরসহ আরও সবার বিরুদ্ধে নতুন করে আওয়াজ তোলেন তিনি।

এবার তারকাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক সমর্থনও পেয়েছেন তনুশ্রী। মহিলা এবং শিশু বিকাশমন্ত্রী মানেকা গান্ধী বলেন, ‘“হ্যাশট্যাগ মি টু”র মতো আমাদের “হ্যাশট্যাগ মি টু ইন্ডিয়া” ক্যাম্পেইন শুরু করা উচিত। কোনো মহিলা যদি কোনোভাবে নির্যাতিতা হন, তা তিনি এখানে লিখে আমাদের জানাতে পারবেন। আমরা তাহলে সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারব।’ মুম্বাইয়ের পুলিশ প্রবীণ অভিনেতা নানা পাটেকর, পরিচালক রাকেশ সারঙ্গ, প্রযোজক শমী সিদ্দিকী এবং কোরিওগ্রাফার গণেশ আচার্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩৫৪ এবং ৫০৯ ধারায় এফআইআর দায়ের করেছে। তনুশ্রী আওয়াজ তুলেছেন পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর বিরুদ্ধেও। চকলেট ছবির সেটে এই পরিচালক তনুশ্রীকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নাচ করতে বলেন। তবে সেদিন এই বলিউড অভিনেত্রী অভিনেতা ইরফান খান ও সুনীল শেঠিকে পাশে পেয়েছিলেন। অবশ্য নানা পাটেকর তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রসঙ্গে সব সময় বলে এসেছেন, ‘এ ব্যাপারে আমি ১০ বছর আগেই কথা বলেছি। যেটা মিথ্যা সেটা মিথ্যাই। আমার আইনজীবী আমাকে এ বিষয়ে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। এ জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।’ গত সপ্তাহে নানা পাটেকর এবং বিবেক অগ্নিহোত্রীর আইনজীবীরা তনুশ্রীকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।

তনুশ্রী আজ অনেককে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন। তাই একের পর এক মানুষের মুখোশ খসে পড়ছে। আপাদমস্তক ভদ্র হিসেবে পরিচিত অলোক নাথের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো অভিযোগ আনেন প্রযোজক বিনতা নন্দা। অভিনেত্রী সন্ধ্যা মৃদুলসহ আরও কয়েকজন নির্যাতিতা আওয়াজ তুলেছেন অলোক নাথের বিরুদ্ধে। লেখক চেতন ভগত, গায়ক কৈলাশ খের এবং অভিজিৎ, পরিচালক বিকাশ বহেল, অভিনেতা রজত কাপুরসহ অনেকের বিরুদ্ধে আজ সরব হয়েছেন নির্যাতিতারা। তবে এত দিন চুপ করে থাকার পর এবার বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমির খান। বলিউডের এই সুপারস্টার অভিযুক্তকারীদের নিন্দা করে বলেছেন, ‘জানতে পেরেছি যে আমি যাঁর সঙ্গে সিনেমা করতে চলেছিলাম তিনিও অভিযুক্ত। আদালতে মামলাও চলছে। এটা আইনের বিষয়। তবে এ মুহূর্তে আমি তাঁর এই প্রোজেক্ট থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ আর এই ব্যক্তিটি হলেন আমিরের পরবর্তী ছবি মুগল-এর পরিচালক সুভাষ কাপুর।

২০১২ সালে অভিনেত্রী গীতিকা ত্যাগী সুভাষের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ আনেন। আমিরের এই সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে ছবিটির প্রযোজক ভূষণ কুমারের কোম্পানি ‘টি-সিরিজ’ সুভাষের সঙ্গে কাজ করতে রাজি নয়। ভূষণ কুমারের বাবা সংগীতজগতের অলিখিত সম্রাট গুলশান কুমারের জীবনের ওপর মোগল বায়োপিকটি নির্মাণ হচ্ছিল। আমিরের আগে হৃতিক রোশনও জানিয়ে ছিলেন যে অভিযুক্তদের সঙ্গে তিনি ভবিষ্যতে কোনো ছবি করবেন না। অভিনেতা রাজকুমার রাও-ও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতীয় চলচ্চিত্র–দুনিয়ার তিন বড় সংস্থা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সিনে অ্যান্ড টিভি আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অলোক নাথের বিরুদ্ধে প্রযোজক এবং লেখিকা বিনতা নন্দার ধর্ষণের অভিযোগের ভিত্তিতে এক নোটিশ জারি করেছেন। আর এই সংগঠন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা নোটিশ জারি করবে। শিল্পীদের সংগঠন সিনটা এ বিষয়ে আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সংস্থা যৌন হেনস্তার জন্য বিশাখা গাইডলাইনের (কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্তার ক্ষেত্রে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নীতি) ভিত্তিতে ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন’ এক কমিটি গঠন করতে চলেছে। প্রডিউসার অব গিল্ড ইন্ডিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পেশাদার সংস্থার সহযোগিতায় তারা নানা কর্মশালার আয়োজন করবে। এ কর্মশালায় শেখানো হবে কর্মক্ষেত্রে যৌন উৎপীড়নের সময় কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে। ১২ জনের এই কমিটিতে চিত্রনির্মাতা কিরণ রাও, একতা কাপুর, আমির খান, সিদ্ধার্থ রায় কাপুর আছেন। দ্য ফেডারেশন অব ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া সিনে এমপ্লয়িজের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন–দুনিয়ার মহিলাদের জন্য আমরা আমাদের দরজা উন্মুক্ত করছি, যেখানে তাঁদের অভিযোগ নথিভুক্ত করা হবে। আমাদের আইনি দল থাকবে তাঁদের সঠিক পথ দেখানোর এবং সহযোগিতা করার জন্য।’

সবশেষে বলা যায়, বলিউডের বরেণ্য অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের কথা। তিনিও আন্দোলনের সমর্থনে সরব হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো মহিলার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অধিকার কারও নেই। কর্মক্ষেত্রে এসব ঘটনা ঘটা একদম ঠিক নয়। এই ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ তুলে আইনের সাহায্য নিয়ে দোষীকে শাস্তি দেওয়া উচিত। আত্মসম্মান, মর্যাদা এবং সামাজিকতার পাঠ শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে রাখা প্রয়োজন।’