নেতিবাচক প্রচারণার জন্যই কি এই গান?

‘দহন’ ছবির দৃশ্যে সিয়াম, ছবি-সংগৃহীত
‘দহন’ ছবির দৃশ্যে সিয়াম, ছবি-সংগৃহীত

শুটিং শুরু নয়, নায়ক-নায়িকা নির্বাচন থেকেই ‘দহন’ ছবিটি নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এবার ছবিটির গান নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনা। তিন দিন আগে এই ছবির একটি গান প্রকাশিত হয়েছে। গানটি প্রকাশের পর রীতিমতো তোপের মুখে পড়েছে গায়ক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, পরিচালক ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান।

সমালোচকদের একটাই কথা, আধুনিক সময়ে বাংলাদেশের সিনেমার এমন কথার একটি গান কীভাবে ব্যবহার করা হলো! গানটি শোনার পরপরই জাতীয় চলচ্চিত্র গীতিকবি, গায়ক, সংগীত পরিচালকসহ চলচ্চিত্র পরিচালকদের অনেকে লজ্জিত হয়েছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে গানটি নিয়ে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

‘দহন’ সিনেমার সমালোচিত গানটির কথাগুলো এমনই, ‘হাজির বিরিয়ানি/ মালে ঢাল পানি/ গাঁজা দেরে টানি/ চড়বে নেশা জমবে খেল/ থাকলে আমদানি/ মাতাল হয়ে হিসু করব দেয়ালে/ শালা যা হবে দেখা যাবে কাল সকালে।’ গানটির কথা লিখেছেন কলকাতার প্রিয় চট্টোপাধ্যায় এবং সংগীত পরিচালনা ও গেয়েছেন সেখানকারই আকাশ সেন।

চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন, ছবিটিকে আলোচনায় আনার জন্য এমন নেতিবাচক কৌশল অবলম্বন করেছেন ‘দহন’-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, যা মোটেও ঠিক নয়। এ ধরনের কাজ চলচ্চিত্রের জন্য ভালো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে না। কেউ কেউ তো এমনও বলেছেন, কলকাতার গীতিকার, গায়ক ও সংগীত পরিচালক হওয়ায় তাঁরা অবলীলায় এমন কাজটি করতে পেরেছেন। কোনো বাংলাদেশি গীতিকবির পক্ষে এই ধরনের গান লেখা সম্ভব হতো না।

গানটির গায়ক ও সংগীত পরিচালক আকাশ সেন আজ বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিত্রনাট্যের চাহিদায় এই গান। কেউ যদি জিতের “বস” ছবিটি কিংবা তামিল ছবি “বিজনেসম্যান” দেখে থাকেন তাহলে সেখানে একটা সংলাপ আছে, “মুম্বাই কো ম্য পেশাব কারওয়ানে আইয়ি হু”। আমি দেখেছি, ছবি দেখার সময় ওখানেই সবচেয়ে বেশি তালি ও শিস পড়েছে। “হাজির বিরিয়ানি” গানটি নিয়ে বলব, বন্ধুরা আমি নিজে কোনো মাদক সেবনের পক্ষে নই। কিন্তু একজন শিল্পী হিসেবে চিত্রনাট্যের চাহিদায় কাজ করতে হয়। নেশার পর কেউ যখন নিয়ন্ত্রণ হারায় তখনকার অবস্থায় এই গানটা পর্দায় দেখা যাবে। সবাইকে বলব, ছবিটা দেখুন, তখন বুঝতে পারবেন নেশা কতটা মারাত্মক।’

‘দহন’ ছবির দৃশ্যে সিয়াম ও পূজা, ছবি-সংগৃহীত
‘দহন’ ছবির দৃশ্যে সিয়াম ও পূজা, ছবি-সংগৃহীত

লেখক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান গানটি নিয়ে বলেন, ‘চরম অবক্ষয়ে অস্তিত্বহীন হওয়ার পরই অস্তিত্ব খোঁজার পালা আসবে আবার। এখন অস্তিত্ব হারাবার দশা চলছে।’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন বলেন, ‘আহা বাংলা গান, আহা বাংলা সংস্কৃতি। জানি না কোন মায়ের সন্তান এই গান লিখেছেন আর গেয়েছেন। তোমার বিদেহী আত্মা শান্তি পাক বাংলা গান। লজ্জা, লজ্জা।’ শফিক তুহিন বলেন, ‘এত ক্রসফায়ার হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ী আর চোরাচালানকারীদের দমনে, অথচ দেশের সবচেয়ে প্রভাবিত মাধ্যম চলচ্চিত্রে তরুণ প্রজন্মকে উসকে দেওয়া ইয়াবা গানের ভাষায় ব্যবহার করার জন্য কি কোনো ব্যবস্থা নেবে মাননীয় সরকার!!! লজ্জা হয় এ দেশের আমি একজন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার!’

গীতিকবি আসিফ ইকবাল বলেন, ‘খুবই বাজে নোংরা গানের কথা।’ উপস্থাপক আনজাম মাসুদ বলেন, ‘আমাদের সর্বনাশ আমরাই করছি। আমাদের মেরুদণ্ড নেই। এভাবে চললে শুধু মেরুদণ্ডই নয়, হেঁটে-চলে খেটে খাওয়ার দুই পয়সাও নাই হয়ে যাবে।’ অসংখ্য সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন পলাশ। তিনি বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে পুরো দেশ যুদ্ধ করছে, আর এরা মাদককে উৎসাহ দিচ্ছে। গানের ভাষা খুবই জঘন্য। গীতিকার ও সংগীত পরিচালক কারা!’

‘দহন’ ছবিটির নির্মাতা রায়হান রাফী। ‘পোড়ামন ২’ ছবি বানিয়ে তিনি বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অনেক যে বলছেন, আলোচনায় আসার জন্য এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা মানতে নারাজ এই নির্মাতা। তবে গানটি শোনার পর যাঁরা কষ্ট পেয়েছেন তাঁদের নিয়ে কোনো অভিযোগও নেই তাঁর। এমনটা হওয়া স্বাভাবিক মনে করছেন এই নির্মাতা। তিনি বলেন, ‘এই গানটা ছবিতে থাকবে। সিয়ামের চরিত্রের যৌক্তিকতা বোঝাতে গানটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে। আসলে গানটি আমাদেরও যে খুব একটা ভালো লেগেছে তা কিন্তু নয়। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে এমনটা করতে হয়েছে। এই গানের মধ্যে ইয়াবা, মদ, গাঁজা, হিসুর মতো শব্দগুলো স্বাভাবিকভাবে তো নেওয়ার বিষয় না। তবে আমাদের এ-ও বোঝা দরকার, এটি মাদক-সন্ত্রাসবিরোধী ছবি। ছবিতে একজন তরুণের মাধ্যমে মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। সিনেমাটা দেখার পর গানটা কারও কাছে অযৌক্তিক মনে হবে না। তারপরও আমি বলতে চাই, আপনারা যাঁরা কষ্ট পেয়েছেন, তাঁদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনারা আর একটু ধৈর্য নিয়ে সিনেমা মুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। ভালো একটি কাজ আমরা করতে যাচ্ছি। আপনাদের নিরাশ করব না।’