নৈঃশব্দ্য ও সংগীতের অন্নপূর্ণা

বিদুষী অন্নপূর্ণা দেবী (১৯২৭–১৩ অক্টোবর ২০১৮)
বিদুষী অন্নপূর্ণা দেবী (১৯২৭–১৩ অক্টোবর ২০১৮)
মাইহার ঘরানার পথিকৃৎ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কনিষ্ঠ কন্যা বিদুষী অন্নপূর্ণা দেবী গত শনিবার মৃত্যুবরণ করেছেন। স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৪১ মিনিটে ভারতের মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ৯১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। কিংবদন্তি এই সংগীতজ্ঞের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

‘দুজনে বাজাতে গেলে কিছু প্রবলেম হচ্ছে অন্নপূর্ণা।’

৩০ মার্চ ১৯৫৫। দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাব আয়োজিত সংগীত সম্মেলনের শেষ দিন। রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবী বাজালেন রাগ শ্রী। বাড়িতে এসে খাবার টেবিলে খেতে খেতে কথাটা বলেছিলেন রবিশঙ্কর।

অন্নপূর্ণা রবিশঙ্করের কথাটা প্রথমে বোঝেননি। তিনি পরিষ্কার বললেন, সময় এগিয়ে যাচ্ছে। যুগের পরিবর্তন হচ্ছে। রাজদরবার থেকে জনতার মঞ্চে পরিবেশিত হবে শাস্ত্রীয় সংগীত। সেইমতো বাজনায় কিছু পরিবর্তনও আনতে হবে।

অন্নপূর্ণা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, বাবার (ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ) কাছে যেমনটা শিখেছেন, সে পথেই হাঁটবেন। আজীবন। তাঁর যশ-খ্যাতি-অর্থ কিছুই চাই না। কেবল সুরের সাধনা করবেন। যেমনটা আলাউদ্দিন শিখিয়েছিলেন রবিশঙ্করকেও।

সুরবাহার হাতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবী
সুরবাহার হাতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবী

স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্নপূর্ণা বইয়ে ঘটনাটি এভাবেই বর্ণনা করা আছে। সেই রাতেই হয়তো দুজনের পথ আলাদা হয়ে গিয়েছিল। সেদিন, তার আগেও, রবিশঙ্কর-অন্নপূর্ণার দ্বৈত সুরবাহার বাদনে প্রশংসা বেশি পেতেন অন্নপূর্ণাই। তবু তিনি প্রতিজ্ঞা করে ফেললেন, লোকরঞ্জনের জন্য মঞ্চে তিনি বাজাবেন না। নীরবেই করেছিলেন প্রতিজ্ঞাটা—বাবার সংগীত তিনি ছড়িয়ে দেবেন শিষ্যদের মাঝে। বাংলা আত্মজীবনী রাগ অনুরাগ-এ পণ্ডিত রবিশঙ্করও বলেছিলেন, তাঁর মনে হয়, অন্নপূর্ণা অন্যকে শেখানোটাই বড় মনে করেন।

ইউটিউবে সাকল্যে তিনটি রেকর্ড পাওয়া যায় অন্নপূর্ণা দেবীর। দুটি একক বাদন—রাগ মাঁঝ খামাজ ও কৌশি কানাড়া। আর রবিশঙ্করের সঙ্গে একটি ডুয়েট—ইমন কল্যাণ। সেসব শুনলে বোঝা যায় আলাউদ্দিন খাঁর সংগীতের মর্মকথা। শান্ত, ঋজু অথচ গভীর। স্রষ্টার জন্য সুরের সাধনা, জনসাধারণের হাততালির পরোয়া নয়। ভাই আলি আকবর খাঁ বলেছিলেন, ‘ও যে ঢঙে বাজায়, সেটাই বাবার আসল ঢং। পাবলিকের জন্য অনেক সময় আমাদের বাজনার ঢং পাল্টাতে হয়, তবে তাতে রাগ-রাগিণী বদলায় না, কিন্তু অলংকারগুলি পাল্টে যায়।’

অথচ অন্নপূর্ণাকে সংগীত শেখাতে চাননি আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর কারণ, মেজ মেয়ে জাহানারার মৃত্যু। ঢাকায় রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলেন জাহানারার। কিন্তু কয়েক বছর পর বাবার কাছে মাইহারে (মধ্যপ্রদেশ, ভারত) ফেরত যান তিনি। অপরাধ, জাহানারা বাবার শেখানো ভজন গেয়েছিলেন। অসুস্থ জাহানারা কিছুদিন পর মারা যান।

ছেলে শুভেন্দ্রর জন্মের কিছুদিন পর রবিশঙ্কর–অন্নপূর্ণা
ছেলে শুভেন্দ্রর জন্মের কিছুদিন পর রবিশঙ্কর–অন্নপূর্ণা

এ কারণে রোশনারা তথা অন্নপূর্ণাকে সংগীত না শেখানোর সিদ্ধান্ত আলাউদ্দিনের। সুরের সন্ধানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া (বাংলাদেশ) থেকে অবিভক্ত ভারতের কোথায় না গিয়েছেন তিনি! তাঁর এই জ্ঞান এখন কেবল আলি আকবর খাঁই নিতে পারেন।

কিন্তু আলি আকবরও তো তখন ছোট। মাঠে ঘুরতে, ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসেন। আর বাবা কড়া শাসনে রাখেন, সারা দিন রেওয়াজ করান। একদিন আলি আকবরকে একটা জটিল সুর তুলতে দিয়ে আলাউদ্দিন বাইরে গেলেন। ভুলভাল বাজাচ্ছিলেন আলি আকবর। অন্নপূর্ণা বললেন, ‘দাদা, তুমি ভুল বাজাচ্ছ।’ সুরটা ঠিক করে গেয়ে দিলেন তিনি।

ওদিকে আলাউদ্দিন বাড়ি ফিরে দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। মেয়ের সংগীতজ্ঞান দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। সেদিন থেকেই অন্নপূর্ণার শিক্ষা শুরু হলো। আলি আকবর আপনাদের সেবায় আত্মজীবনীতে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।

মা মদিনা বেগম প্রথম দিকে অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ, মেয়ের বৈবাহিক জীবন! পরে সে আশঙ্কা সত্যিও হলো। রবিশঙ্কর এ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘হয়তো ঠিক যে আমি যতখানি ভালোবাসতে পেরেছিলাম অন্নপূর্ণাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা ও আমায় দিয়েছে। তবে কথা কি, ভালোবাসার তো কোনো বাঁধাছাঁদা মাপকাঠি হয় না... ভালোবাসার যেটা পরিণতি, তার মধ্যে তো একটা মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারও আছে।’সেটা হয়নি দুজনের।

পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত নিত্যানন্দ হলদিপুর, ওস্তাদ বাহাদুর খান, পণ্ডিত যতিন ভট্টাচার্য, ড. রাজীব তারানাথ, পণ্ডিত প্রদীপ বারোত, পণ্ডিত বসন্ত কাবরা, ওস্তাদ আশিস খাঁদের। অন্নপূর্ণা যখন শেখাতেন, বাজিয়ে শোনাতেন না। সুরটা গেয়ে শোনাতেন। ছেলে শুভেন্দ্রশঙ্করকেও অন্নপূর্ণা বড় সংগীতজ্ঞ বানাতে চেয়েছিলেন। রবিশঙ্করের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সংগীত ছাড়া বড় অবলম্বন ছিল এই ছেলে। অনেকে বলেন, মায়ের তালিমে শুভেন্দ্র বাবা রবিশঙ্করের থেকেও গুণী শিল্পী হতেন। সে সমস্ত লক্ষণই ক্রমে ফুটে উঠছিল।

কিন্তু বাবার পশ্চিমি জীবনের হাতছানি বনাম কড়া অনুশাসনে মায়ের সংগীত সাধনা—এই দুইয়ের মধ্যে শুভেন্দ্র বেছে নিলেন প্রথম বিকল্পটি। শেষ পর্যন্ত তাঁর পরিণতি হয়েছিল অকালমৃত্যু।

জাহানারা, আলাউদ্দিন খাঁ, মদিনা বেগম, শুভেন্দ্র, আলি আকবর, রবিশঙ্কর, রুশিকুমার পাণ্ডে (অন্নপূর্ণার দ্বিতীয় স্বামী)—একে একে সবাই চলে গিয়েছিলেন। অন্নপূর্ণা সব শোক সয়েছেন। নৈঃশব্দ্য ও সংগীতে। তিনি আসলে একাই ছিলেন। আর ছিল তাঁর সংগীত। গভীর রাতে, আশপাশে যখন কেউ নেই, সুরবাহার নিয়ে বসতেন অন্নপূর্ণা। আপনমনে বাজিয়ে চলতেন। সুরের জাদুতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত অদ্ভুত সুবাস।

অন্নপূর্ণা দেবীর প্রতিভার পরাকাষ্ঠা বোঝাতে প্রায়ই দুটো কথার আশ্রয় নেওয়া হয়। প্রথম কথাটা আলাউদ্দিন খাঁর সমসাময়িক কিংবদন্তি ওস্তাদ আমির খাঁর—‘আলাউদ্দিন খাঁর ৮০ শতাংশ সংগীত ধারণ করতে পেরেছে অন্নপূর্ণা, আলি আকবর খাঁ ৭০ শতাংশ, আর ৪০ শতাংশ রবিশঙ্কর।’ আর ভাই আলি আকবর বলেছিলেন, ‘রবিশঙ্কর, পান্নালাল ঘোষ আর আমাকে এক পাল্লায় রেখে আরেক পাল্লায় অন্নপূর্ণাকে রাখলে ওর পাল্লাই ভারী হবে।’

অতিকথন? বিদুষী অন্নপূর্ণা দেবীর শিষ্যদের সংগীত শুনুন।