উড়াল দিলেন আকাশে

আইয়ুব বাচ্চু (১৬ আগস্ট ১৯৬২—১৮ অক্টোবর ২০১৮)। ছবি: প্রথম আলো
আইয়ুব বাচ্চু (১৬ আগস্ট ১৯৬২—১৮ অক্টোবর ২০১৮)। ছবি: প্রথম আলো
>

রুপালি গিটার ফেলে বহুদূরে চলে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু। বাংলা ব্যান্ডের এই কিংবদন্তি তাঁর গানে গানে বলেছিলেন, ‘সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে’। কিন্তু অশ্রু গোপন রাখা সহজ নয়। দীর্ঘদিনের সংগীতজীবনে তাঁর বন্ধুর সংখ্যা ছিল অগুনতি। সেই বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শিকড় বিস্তৃত ছিল অনেক গভীরে। গতকাল বৃহস্পতিবার আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে প্রথম আলোর কাছে নিজেদের অনুভূতির কথা জানালেন শিল্পীর কয়েকজন কাছের মানুষ।

একনজরে আইয়ুব বাচ্চু
জন্ম: ১৬ আগস্ট ১৯৬২, চট্টগ্রাম
মৃত্যু: ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ঢাকা
সংগীতজীবন শুরু: ১৯৭৭
প্রথম গান: হারানো বিকেলের গল্প
ব্যান্ড: প্রথম ব্যান্ড ফিলিংস (১৯৭৮)। এরপর যোগ দেন সোলস–এ। ১৯৮০ থেকে পরবর্তী এক দশক এই ব্যান্ডে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯১ সালে নিজে গঠন করেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। প্রথমে এলআরবির পূর্ণ অর্থ ছিল লিটল রিভার ব্যান্ড। পরে এই নাম বদলে করা হয় লাভ রানস ব্লাইন্ড।
প্রথম একক অ্যালবাম: রক্তগোলাপ (১৯৮৬)
এলআরবির প্রথম অ্যালবাম: এলআরবি (১৯৯২)

ব্যান্ড অ্যালবাম
এলআরবি (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারী মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮), যুদ্ধ (২০১২)

একক অ্যালবাম
রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৮), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইনস্ট্রুমেন্টাল, ২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)

কিছু জনপ্রিয় গান
চলো বদলে যাই, রুপালি গিটার, হাসতে দেখ, ঘুমভাঙা শহরে, দরজার ওপাশে, ফেরারি এ মনটা আমার, মেয়ে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, কেউ সুখী নয়, বেলা শেষে ফিরে এসে, এক আকাশের তারা, তারাভরা রাতে, উড়াল দেব আকাশে, একচালা টিনের ঘর, মন চাইলে মন পাবে, আমি তো প্রেমে পড়িনি, তিন পুরুষ, তাজমহল, বারো মাস, এই রুপালি রাত ইত্যাদি।
এ ছাড়া অনেক মিশ্র অ্যালবামে তিনি কাজ করেছেন। এর মধ্যে প্রিন্স মাহমুদের সুরে করা মিশ্র অ্যালবামগুলোতে তাঁর গান আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর সেরা গানগুলো নিয়ে একটি অ্যালবাম বের করা হয়। প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রেও গেয়েছেন। যেখানে তাঁর ‘আম্মাজান’ গানটিকে বাংলা সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় গানগুলোর একটি ধরা হয়।

আমাকে ফেলে চলে গেলি?
কুমার বিশ্বজিৎ, সংগীতশিল্পী
আমাদের সংগীতজীবনের সম্পর্ক ছিল ৪৫ বছরের। প্রথম যখন রিদম ৭৭ নামে একটা গানের দল করি আমরা, সেটা থেকে ধরলেও ৪১ বছরের। অনেক ছোট ছোট স্মৃতি, আবেগ, অনুভূতি, দুঃখ, বেদনার সাক্ষী আমরা। বাচ্চু যখন ঢাকায় প্রথম এল, তখন আমার বাসাতেই উঠেছিল। দুই রুমের বাসায় এক রুমে ও প্র্যাকটিস করত, আরেক রুমে আমি। খাওয়াদাওয়া একসঙ্গে করতাম। পরে ও আমার বাসার পাশেই বাসা ভাড়া নেয়। জানালা দিয়ে কথা হতো। আমার বাসায় থেকেই ওর প্রেম এবং পরিণয়। ওর বিয়ের বাজার পর্যন্ত করা হয়েছিল সেখান থেকেই। গত পরশু দিনও আমরা কথা বলেছি। কথা শেষ করার আগে শুধু বলল, ‘দোস্ত, মাসিমাকে দেখতে আসব।’ সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, মাকে এখনো বলতে পারিনি। মা বাচ্চুকে তাঁর আরেক সন্তান বানিয়েছেন। বাচ্চু শুধু আমার বন্ধু নয়, ভাইও। বলতে কেমন শোনা যাবে জানি না, তবে ও আমার সঙ্গে প্রতারণা করল। তুই আমাকে ফেলে কেন চলে গেলি?

আমার ভাইকে হারালাম
জেমস, সংগীতশিল্পী
আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ১৯৮০ সালের শুরু থেকে। হাজারো স্মৃতির সাক্ষী আমরা। তাঁর চলে যাওয়া বাংলা গানের জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। কোনোভাবেই মানতে পারছি না এই চলে যাওয়া। বাংলাদেশের শ্রোতারা তাঁর গান মনে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার এক ভাইকে হারালাম। আজ (গতকাল) বরগুনায় হচ্ছে উন্নয়ন কনসার্ট। মনটা মানছে না কিছুতেই। তবে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, আজকের কনসার্টটি আমরা উৎসর্গ করব আইয়ুব বাচ্চুকে।

তিনি ব্যান্ড সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র
ফাহমিদা নবী, সংগীতশিল্পী
আইয়ুব বাচ্চু নেই, ভাবতে পারছি না। তাঁর এই অসময়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আজ একটা কথা বলতে চাই, কোনো শিল্পীকেই যেন আমরা কষ্ট, দুঃখ না দিই। আমরা যেন সবাইকে তাঁর যথাযথ সম্মানের জায়গাটা দিতে পারি। কেউ যেন অভিমানভরা বুকে অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে না যায়। আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। একটা ইতিহাসও। সেই নক্ষত্র ঝরে গেল আজ (গতকাল)।

এক বসাতেই গান করে দিতে পারতেন
লতিফুল ইসলাম শিবলী, গীতিকবি
বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার এক যুগের সম্পর্ক। প্রথম তাঁর তবুও অ্যালবামে লিখেছিলাম ‘মাকে বলিস’ গানটি। এরপর থেকে ‘কষ্ট’, ‘স্ক্রু ড্রাইভার’, ‘নীল বেদনা’, ‘হাসতে দেখ’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘রাজকুমারী’, ‘আহা জীবন’সহ তাঁর সঙ্গে কত গানের স্মৃতি! বাচ্চু ভাইয়ের জন্য আমি ৫০–৬০টি গান লিখেছি। গান আর গিটারের গুণী মানুষ ছিলেন তিনি; এক বসাতেই গান করে দিতে পারতেন। বাচ্চু ভাই, জেমস ভাই ও আমি একসঙ্গে থাকা, খাওয়া, আড্ডায় কত দিন কত রাত যে পার করেছি। তাঁর সঙ্গে আমার বড় ভাই, বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল। আমরা দুঃখ–কষ্ট, প্রেম–ভালোবাসার কথা শেয়ার করতাম। এর ফলে ‘নীল বেদনা’ বা ‘কেউ সুখী নয়’সহ আরও অনেক জনপ্রিয় গানের জন্ম হয়েছে।

রুপালি গিটারটি ফেলে বহুদূরে চলে গেলেন
হাসান, সংগীতশিল্পী
বাচ্চু ভাই বলে গেছেন, ‘এই রুপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে’। সত্যিই তিনি রুপালি গিটারটি ফেলে বহুদূরে চলে গেলেন। আমি আমার মতো করে বলতে পারি, সুর কখনো মুছে যায় না। তাই আমি বলব, বাচ্চু ভাই তাঁর কর্ম, গান, সুরে বেঁচে থাকবেন। আমরা যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, তাদের কাছেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর সঙ্গে আমি অনেক গান করেছি। অনেক মঞ্চে গান করেছি।

বলার কোনো ভাষা নেই
কৌশিক হোসেন তাপস, সংগীতশিল্পী
বুধবার দুপুরে বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় ফিরলাম রংপুরে আমাদের প্রথম উন্নয়ন কনসার্ট শেষ করে। কথা ছিল, আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) দুপুরে তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হবে। আমরা একসঙ্গে কাল (আজ শুক্রবার) রাজশাহী যাব আমাদের দ্বিতীয় উন্নয়ন কনসার্টে। রাজশাহীর শো নিয়ে বাচ্চু ভাই বলেছিলেন, ‘উড়িয়ে দেব, তাপস।’ আমার আর বলার কোনো ভাষা নেই। তিনি আমার আপন বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। ২০-২১ বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের। কদিন আগেই গান বাংলার অফিসে এসে তিনি আমাকে একা ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন কষ্টের কথা।

বাচ্চু ভাই মানেই অনুপ্রেরণা
শারমীন সুলতানা সুমী, সংগীতশিল্পী
আমরা ‘চিরকুট’–এর সবাই অস্ট্রেলিয়ায় আছি এই মুহূর্তে। একটা জায়গায় যাওয়ার পথে খবরটা পাই। তারপর রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকেছি। কেঁদেছি। আসলে আমরা তো বাচ্চু ভাইয়ের গান শুনে শুনে বড় হওয়া প্রজন্ম। আমরা জানতাম, সংগীত মানেই আইয়ুব বাচ্চু। পরে আমরা গানে নিয়মিত হলে বাচ্চু ভাই ছিলেন বড় অনুপ্রেরণা। বাচ্চু ভাই মানে প্রজন্মের পর প্রজন্মের এক হওয়া। তাঁর কত কালজয়ী গান; এখন শুনলেই বুক খালি লাগবে। এখন একটা অভিভাবক শূন্যতা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে।