জানালা বন্ধ করে তিনি দরজার ওপাশে

আইয়ুব বাচ্চু (১৯৬২-২০১৮)
আইয়ুব বাচ্চু (১৯৬২-২০১৮)

ধুঁকে ধুঁকে ফুরিয়ে যাওয়ায় থাকে ধিকিধিকি জ্বলা। কিন্তু সে জ্বলায় কষ্ট থাকে ঠিকই, আবার প্রস্তুতিও থাকে। হুট করে যাওয়ায় মানে—মুখের ওপর জানালাটা ঠাস করে বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর কখনো এটা খুলবে না। বড় হয়ে ওঠা বুঝি সবকিছু সয়ে নিতে পারার দীর্ঘশ্বাসও? তবে স্বস্তির কথা, জানালা দিয়ে নতুন কিছু দেখার অপেক্ষা তো ফুরোল।

জানালা যে আর নেই, তা নয়। আছে প্রচুর—লাগে যত। মনের অতলে সব সাজানো। কোথাও লাটিম থেকে নাটাই, কোথাও বা ব্যাট-বল থেকে ফুটবল; রুচছে না? আছে দিঘির কালো জল। ছিপ আর মার্বেলের টিপ। উডিউড পেকার, রবিনহুড আর কঙ্কাল দ্বীপে তিন গোয়েন্দা। লুকিয়ে মাসুদ রানা! আরও কতশত…বলতে গেলে শেষ হবে না। আহা, আমার নব্বইয়ের শৈশব আর কৈশোরকে ফিরে দেখার জানালা!

কিন্তু সেই জানালাটা কাল থেকে বন্ধ। এমন আরও আছে। একেকটিতে ফিরে তাকানোর একেক রকম সুর আর স্বাদ। ওটারও তা থাকবে। তবে ধারণকৃত। তাকালে চোখ ভিজে আসে।

ভেজা চোখে ঝাপসা দেখি। রগড়ে নিতেই টলটলে পরিষ্কার। ওই তো, তিন কুঠুরি এক দরজার বাড়িটা। বসার ঘরে একটা জানালা। শিকের ছড়াছড়ি। রোজ চুল সিঁথি করে স্কুলে যাও। এটা করো না, ওটা শোনো না।

বড়রা কী করতেন জানি না, তবে শুনতেন। বসার ঘরে একদিন সুদকষার সময় পাশের বাড়ির ডেকসেট থেকে কানে এল ‘কত রাত আমি কেঁদেছি/বুকের গভীরে কষ্ট নিয়ে/শূন্যতায় ডুবে…আমি।’

সুরটা তিরের ফলা হয়ে ভেতরে গেঁথে গেল। কথাগুলোর সম্ভাব্য মানে বুঝেছি বড় হয়ে। তখনো বুঝেছিলাম। আদেশ-নিষেধে মোড়ানো শৈশবের আর্তনাদ। ‘সেই তুমি’ও কি ছিল? কিছু বুঝি কিছু বুঝি না, শুধু অনুভূতির সেই বয়সটা কিন্তু কল্পনাতেও দুঁদে চিত্রকর।

গান সেই সব ছবি আঁকার একরকম তুলি। সহজে মিলত না। সেই বয়সে হাতে ক্যাসেট? ফের জ্যাঠামো! বাড়ির ভেতর হাতটা বড়জোর কলম থেকে টিভি চালানোর। হাত পাকাতে হতো বাইরে। সাইকেল চেপে প্রাইভেটে যাওয়ার সোজা পথ ছেড়ে নিউমার্কেটের গলি। বনলতা ক্যাসেট রেকর্ডিং। হ্যাঁচকা ব্রেক। কি বাজাচ্ছে রে? ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি।’

-শুভেচ্ছায় শুনছি।
- আরে ধুর! টিভির সাউন্ড আর এইটার সাউন্ড! এমন টাস টাস করে কী বাজায়?
-ড্রামস।
-আর ঝ্যাঁ ঝ্যাঁ—চিনচিনে শব্দটা?
-ইলেকট্রিক গিটার।

ক্যাসেট কিনতেই হবে। ২০-২৫ টাকা পাই কোথায়? চল, পুরোনো বইয়ের দোকানে। তিন গোয়েন্দার দুটো ভলিউম বেচলে মামলা খালাস! বাসায় এই গান শোনা যাবে না। ওখানে শুধু শুভেচ্ছা আর ব্যান্ড শোর অপেক্ষা। আর ঈদ। আহা ঈদ!

পরম মুক্তির দিন-তারিখ। মাঠে-ঘাটে, স্কুলে, ক্যাসেট কিংবা সিনেমা হল, কোথায় নয়! ঈদের অ্যালবাম কবে বেরোচ্ছে? সলো না মিক্সড? ক্যাসেটের গায়ে কার ছবিটা বড়? জানিস, ঈদের গানগুলো আলাদা কেন? বারে, ঈদের খুশির সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে! নতুন অ্যালবামের গান ছিল সেই খুশির ক্যানভাসে আরেক কাঠি বাড়তি রং।

স্কুল থেকে কলেজে ওঠার সঙ্গে ক্যাসেটের গায়ে ছবিটাও ছোট হয়ে এসেছে। কলেজ থেকে বড় কলেজ মানে লোকে যাকে বলে বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন অনেকটাই ক্যাসেট থেকে সিডি প্লেয়ার হয়ে ইউটিউব জমানায়। তত দিনে গলাটাও আগের মতো নেই। কিন্তু জীবন্ত মুখটা ছিল।

এখন যেহেতু নেই, তাই বন্ধ জানালায় তাকাই। ধারণকৃত ছবি দেখি। মনের মঞ্চে রুপালি গিটার ফেলে যাওয়ার মূর্ছনা আর স্মৃতির টু-ইন-ওয়ানে একদিন ঘুমভাঙা শহরে একটি কিশোর ছেলে…।

সেই ছেলেটি বারবার ফিরে ফিরে আসছে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে তাঁর জিজ্ঞাসা, ক্যাসেটের দিনগুলোর এক সারথি তো গেল। সবাই যখন তাঁর লিংক খুঁজছে, তখন মঞ্চে আরেক সারথি কাঁদছে। এভাবে একদিন শৈশবের সব যাবে। প্রস্তুতি আছে?

আছে মানে! জানালাটা বন্ধ তো কী হয়েছে? কাভারিং অ্যান্ড ফিচারিং হবে। তা না হলে ইউটিউব। বছরে রোজ দুবার নিয়ম করে স্মরণ। স্ট্যাটাস, শেয়ার। আর কী চাই!

যা চাই, তা হলো সেই ফলাটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। বেঁধা জরুরি। নাকি গায়ে-গতরে বেড়ে ওঠায় বুকটা সীমারের মতো শক্ত! রুপালি গিটার ফেলে তিনি এখন দরজার ওপাশে। আর আমরা সেই শোকে এপাশ থেকে সুন্দর করে আহা, উঁহু, ইশ্‌ প্রকাশে ব্যস্ত। আবেগমথিত এই শোক–সৌন্দর্যচর্চার ফাঁকে হুট করে মনে পড়ল, শৈশবের সেই জানালাটা কাল থেকে বন্ধ।