'বস'কে নিয়েই টিকে থাকবে এলআরবি

>

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি : আনন্দ
আইয়ুব বাচ্চু। ছবি : আনন্দ

তাঁর ধ্যানে–জ্ঞানে, জীবনযাপনে যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল গিটার আর গান, তেমনি আইয়ুব বাচ্চু আর এলআরবি ছিল মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। সব সময় তিনি বলতেন, ‘আমার পরিবারের বাইরে আরেকটি পরিবার “এলআরবি”। বললে বাড়াবাড়ি হবে না, আইয়ুব বাচ্চুর কারণেই শুরু থেকে এলআরবি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। শেষ পর্যন্ত সেই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন থাকে। বিগত ২৭ বছরে এলআরবির পথচলা, আইয়ুব বাচ্চুর অবর্তমানে এলআরবির ভবিষ্যৎ—এসব নিয়ে এই প্রতিবেদন।

এ কথা হয়তো সব ভক্তই জানেন, এলআরবি নামটা বিস্তারিত হচ্ছে ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। শুরুটা ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল। আইয়ুব বাচ্চুই প্রথম স্বপ্ন দেখেন এলআরবির। জয়, টুটুল ও স্বপনকে নিয়ে যখন এ দেশে এলআরবির যাত্রা শুরু হয়, তখন সারা দেশে ব্যান্ড সংগীতে উন্মাতাল তারুণ্য। সোলস ছেড়ে বাচ্চু অনেকটা উত্তাল সমুদ্রে জাহাজ ভাসালেন। সঙ্গে ফিলিংস, স্পাইডার কিংবা সিঞ্জন থেকে আসা তিন তরুণ জয়, টুটুল ও স্বপন। ১৯৯১ সালে যখন এলআরবি গঠিত হয়, তখন তাদের লাইনআপ ছিল এমন—লিড গিটার ও ভোকাল আইয়ুব বাচ্চু, বেস গিটারে স্বপন, কি–বোর্ডে টুটুল ও ড্রামসে জয়।

অবশ্য শুরুতে নামটা এলআরবি ছিল না। নাম ছিল ওয়াইআরবি—ইয়েলো রিভার ব্যান্ড। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু জানিয়েছিলেন, ‘ইয়েলো রিভার ব্যান্ড’ নাম নিয়ে তাঁরা প্রথম আমেরিকান ক্লাবে শো করতে যান। ওই অনুষ্ঠানে আয়োজকেরা ভুলক্রমে তাঁদের ব্যান্ডের নাম লেখেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। ভুল হলেও নামটা অপছন্দ হয়নি দলের সদস্যদের। ওই নামই রেখে দেওয়া হয়। ব্যান্ড পরিচিত হয় এলআরবি নামে। বেশ চলছিল, কিন্তু পরে আইয়ুব আবার জানতে পারেন, ওই নামে অস্ট্রেলিয়াতে একটি ব্যান্ড রয়েছে। কিন্তু এলআরবি—এই তিনটি শব্দ পরিবর্তন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। যা করা সম্ভব ছিল তা হলো, ওই তিনটি শব্দের মধ্যে থেকেই নতুন নামের জন্ম দেওয়া। সফলভাবে সেটি করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু—‘লাভ রানস্ ব্লাইন্ড’ পুরোনো মোড়কে জন্ম নিয়েছিল নতুন এলআরবির।

যে জাহাজের নাবিক আইয়ুব বাচ্চু, সাফল্যের বন্দরে ভিড়বেই সে জাহাজ। শুরু থেকেই হার্ড রক ব্যান্ড হিসেবে এলআরবির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। মঞ্চ পরিবেশনা কিংবা অ্যালবাম প্রকাশনা, হার্ড রকই বরাবর প্রাধান্য পেয়েছে। তবে কখনো এক ধরনের সংগীত নিয়ে থেমে থাকেনি এলআরবি, বরং বরাবরই দলের সদস্যরা নিজেদের সংগীতে এনেছেন নতুনত্ব। চালিয়েছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নতুনত্ব আনার চেষ্টা ছিল বরাবরই। অ্যালবামের গান কিংবা মঞ্চ পরিবেশনায় কখনো পুরোদস্তুর হার্ড রক, কখনো সফট মেলোডি আবার কখনো সুর-সংগীতে একেবারেই পশ্চিমা ধাঁচ খুঁজে পাওয়া গেছে এলআরবির গানে। সংগত কারণেই তাই এলআরবির ভক্তদের কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি ছিল না।

এলআরবির সব সদস্য একসঙ্গে
এলআরবির সব সদস্য একসঙ্গে

এলআরবি দলটি প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই সারা দেশে পরিচিতি পায়। মঞ্চ পরিবেশনায় তারা হয়ে ওঠে আয়োজকের প্রথম পছন্দ। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে দুটি অ্যালবাম বের করার কৃতিত্বটাও এলআরবির। ১৯৯২ সালের ১১ জুন এলআরবি প্রথমবারের মতো একসঙ্গে দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। এলআরবি ১, ২ শিরোনামে এই ডাবল অ্যালবাম বের হয় সারগামের ব্যানারে। নবীন ব্যান্ড হয়েও প্রথম সারির ব্যান্ডগুলোর মাঝে অল্প সময়েই নিজেদের আসন পোক্ত করে এলআরবি। তাদের প্রথম ডাবল অ্যালবামের হকার, পেনশন, ঘুম ভাঙা শহরে, মাধবী, ফেরারি মন গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এলআরবির গানের বিশাল শ্রোতাশ্রেণি তৈরি হয়। পরের বছরই সাউন্ডটেকের ব্যানারে সুখ শিরোনামে দ্বিতীয় অ্যালবাম বাজারে আসে। এই অ্যালবামে স্থান পাওয়া ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে...’ গানটি এলআরবির জনপ্রিয়তাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়। এ ছাড়া রুপালি গিটার, সুখ, গতকাল রাতে গানগুলোর কথা ও সুরের গভীরতায় এলআরবির স্বকীয়তা ফুটে ওঠে। এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে তৃতীয় অ্যালবাম বের হয় সারগামের ব্যানারে। শ্রোতারা প্রায়ই এই অ্যালবামকে ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করেন। তবুও শিরোনামের ওই অ্যালবাম ছিল পুরো হার্ড রকের। অ্যালবামের ‘বাংলাদেশ’, ‘মাকে বলিস’, ‘জারজ সন্তান’ গানগুলোও শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় এসে যায়। ১৯৯৫ সালে প্রকাশ পায় ঘুম¯শহর শিরোনামে চতুর্থ অ্যালবাম। শিরোনাম সংগীতসহ এই অ্যালবামেরও বেশ কয়েকটি গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরের বছর পুরোনো এবং নতুন গানের সমন্বয়ে তারা ফেরারি মন শিরোনামে আরও একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম আনপ্লাগ্ড অ্যালবাম। অ্যালবামটি রেকর্ড সংখ্যক বিক্রি হয়। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতার ব্যানারে প্রথমবারের মতো প্রকাশ পায় এলআরবির স্বপ্ন। আমাদের ও বিস্ময় শিরোনামে একসঙ্গে দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করে এরপর। অ্যালবাম প্রকাশের সংখ্যা কমিয়ে দেয় তারা।

২৭ বছরে বেশ কয়েকবার এলআরবিতে পরিবর্তন এসেছিল। ১৯৯১ সালে যখন এলআরবি প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মাথায় অর্থাৎ, ১৯৯৩ সালে জয় ব্যক্তিগত কারণে ব্যান্ড থেকে বিদায় নেন। ড্রামার মিল্টন আকবর (চলচ্চিত্রের অভিনেতা শওকত আকবরের ছেলে) যোগ দেন এলআরবিতে। একসময় কি–বোর্ডিস্ট টুটুলও এলআরবি থেকেই বিদায় নেন ব্যক্তিগত কারণে। তাঁর জায়গায় নতুন কোনো কি–বোর্ডিস্ট আসেননি এলআরবিতে। লিড গিটারিস্ট হিসেবে এলআরবিতে যোগ দেন মাসুদ। পরে তিনিও ব্যক্তিগত কারণে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিলে ড্রামার হিসেবে যোগ দেন রিয়াদ। একসময় রিয়াদও ব্যক্তিগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে ড্রামার হিসেবে যোগ দেন রোমেল। ব্যবস্থাপক হিসেবে দলের সঙ্গে সদস্য হয়েই যোগ দেন শামীম আহমেদ।

আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন পুরোদস্তুর মিউজিশিয়ান। দিনের বেশির ভাগ সময় এলআরবির সদস্যদের সঙ্গেই আইয়ুব বাচ্চুর দিন কাটত। এলআরবির অন্য সদস্যরা আইয়ুব বাচ্চুকে ‘বস’ বলেই ডাকতেন। বলতেন, ‘আমাদের মাথার ওপর ছায়া হিসেবে আছেন বস। তাঁকে অভিভাবক মনে করি।’ হয়তো এমন হৃদ্যতার কারণেই পুরোপুরি পেশাদার ব্যান্ড হিসেবে ২৭ বছর পার করেছিল এলআরবি। আইয়ুব বাচ্চুর নেতৃত্বে দিনের বেশির ভাগ সময়ই নিজস্ব স্টুডিও ‘এবি কিচেনে’ কাটিয়েছিলেন তাঁরা। গল্প, আড্ডা, কাজ নিয়েই কেটে যেত তাঁদের দিন। ব্যান্ডের অন্য সদস্যদের উদ্দেশে আইয়ুব বাচ্চু প্রায় সময় একটা কথা বলতেন, ‘ওদেরকে এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি আমার পরিবারের বাইরের কেউ।’

এলআরবির ভবিষ্যৎ

সংগীতজীবনের বেশির ভাগ সময় নিজের হাতে গড়া ব্যান্ড এলআরবিকেই দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। এলআরবি তথা সব ছেড়ে তিনি এখন অনতিক্রমনীয় দূরত্বে। তাঁকে পাওয়া যাবে না এলআরবির কোনো আয়োজনে, গিটার হাতে গাইবেন না গানের আসরে। এটাই চরম বাস্তবতা। গত কয়েক দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন আলাপচারিতায় উঠে এসেছে কয়েকটা প্রশ্ন, এলআরবির ভবিষ্যৎ কী? কীভাবে চলবে এই ব্যান্ডের কার্যক্রম? কারা থাকবেন এর সঙ্গে? লিড গিটার আর গান গাওয়ার জন্য নতুন কেউ যুক্ত হচ্ছেন? একটা বিষয়ে সবারই একমত, আইয়ুব বাচ্চুর বিকল্প নেই।

এলআরবির ভবিষ্যৎ নিয়ে দলের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বললেন, ‘এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার (আজ) আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। আমরা আইয়ুব বাচ্চুর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এলআরবিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আহনাফ তাজোয়ার এখন কানাডায় পড়াশোনা করছেন। এ সময় আমরা তাঁকে কোনো চাপ দেব না, প্রয়োজনে তাঁকে সহযোগিতা করব।’ তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় আরেকজন আইয়ুব বাচ্চুকে পাওয়া যাবে না, এটা সত্যি। তবে ব্যান্ডের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার জন্য আমরা নতুন সদস্য যুক্ত করব। আইয়ুব বাচ্চুর গান দেশে অনেকেই চর্চা করেন। আমরা হয়তো কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে “এলআরবির জন্য ভোকাল হান্ট” করব। যাঁকে পাওয়া যাবে, তাঁকে এলআরবির মতো প্রস্তুত করব। আমরা এলআরবিকে রাখতে চাই। গান নিয়ে, এলআরবি নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর স্বপ্নের কথা আমরা জানি। সেসব স্বপ্ন পূরণের জন্য এলআরবিকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’