লোকসুরের ভরা হাটে

ঢাকা আন্তর্জাতিক লোক উৎসবের প্রথম দিনে সংগীত পরিবেশন করেন নারায়ণগঞ্জের আবদুল হাই দেওয়ান। গতকাল বনানীতে বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঢাকা আন্তর্জাতিক লোক উৎসবের প্রথম দিনে সংগীত পরিবেশন করেন নারায়ণগঞ্জের আবদুল হাই দেওয়ান। গতকাল বনানীতে বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে। ছবি: সাইফুল ইসলাম

খোলা ময়দানে গান শুনে মাঝরাতে বাড়ি ফেরার দিন ফিরে এল। ফিরে এল দুনিয়ার নানা প্রান্তের শিকড়ের সুরে মিশে যাওয়ার দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীর বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে বসেছে সেই সুরের মিলনমেলা। শুরু হয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক লোক উৎসব ২০১৮।

সান ফাউন্ডেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক লোকগানের উৎসবের জমকালো উদ্বোধন হলো গতকাল সন্ধ্যায়। টানা ছয় ঘণ্টার আসরে দেশ-বিদেশের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

লোকনৃত্য দিয়ে শুরু হয়ে ভারতের ওয়াদালি ব্রাদার্সের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে উৎসবের প্রথম দিনের আয়োজন। মাঝে এসে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, ঢাকা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ও গ্রামীণফোনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান। স্বাগত বক্তব্য দেন সান ফাউন্ডেশন ও সান কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী।

উদ্বোধনী বক্তৃতায় আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এমনিতে বাংলার লোকসংগীত যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যের দিক থেকেও অন্যদের তুলনায় বিশেষভাবে উন্নত। এই সময়ে এসে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে লোকসংগীত পেয়েছে নতুন মাত্রা।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘লোকসংগীতের এই উৎসবে তারুণ্যের স্রোত আমাকে অভিভূত করেছে। লোকসংগীতের জয় হোক, তারুণ্য ও যৌবনের জয় হোক।’

এই উৎসবের মাধ্যমে লোকসংগীতের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে নতুন করে চিনবে বলে আশা করেন মেয়র সাঈদ খোকন।

উদ্বোধনীপর্বে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান সান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী। প্রথম আলো
উদ্বোধনীপর্বে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান সান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী। প্রথম আলো

এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্যব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যজবাদ দেন অঞ্জন চৌধুরী। তিনি বলেন, সান ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশে লোকসংগীতের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা এবং শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান ও রয়ালটি নিশ্চিত করা। সেই বিষয় সামনে রেখে গত তিন বছরের মতো এবারও আয়োজন করেছি আমরা।’

বর্ণিল এই অনুষ্ঠানে দর্শকদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ। তাঁরা প্রমাণ করেছেন ডিজিটাল যন্ত্রের দাপটের যুগে লোকসংগীতের প্রতি তরুণদের আগ্রহ কমেনি, বরং বেড়েছে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মঞ্চে আসে নাচের দল ভাবনা। সামিনা হোসেন প্রেমার পরিচালনায় জনপ্রিয় লোকগানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে দলটি। এরপর ছিল রাঙামাটি অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা। রায়বেঁশে নাচ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাচের পালা।

‘মাগো মা, ঝিগো ঝি, করলাম কী রঙে’ গান নিয়ে মঞ্চে আসেন নারায়ণগঞ্জের আবদুল হাই দেওয়ান বাউল। তিনি আরও শোনান ‘তুমি কোন বা দেশে রইলারে দয়াল চান’সহ বেশ কিছু গান।

আবদুল হাই দেওয়ানের পরে মঞ্চে আসে পোল্যান্ডের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লোকগানের দল দিকান্দা। দলপ্রধান আনিয়া উইটজাক গাওয়ার পাশাপাশি অ্যাকোর্ডিয়ান বাজিয়ে শোনান। ভাঙা বাংলায় বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মন খুব ভালো। অচেনা সুর, অচেনা সুরযন্ত্র আর শিল্পীদলের মুখে ভাঙা ভাঙা বাংলায় শুভেচ্ছাবাণী শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছেন ঢাকার দর্শকেরা।

এরপর মঞ্চে আসেন ভারতের সাত্যকি ব্যানার্জি। ইউটিউবের কল্যাণে বাংলাদেশে যে সাত্যকি দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তার প্রমাণ মেলে মঞ্চ থেকে তাঁর নাম ঘোষণার পর। কখনো একতারা, কখনো দোতারা হাতে তিনি ‘আমার একলা নিতাই’, ‘দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না’সহ বেশ কিছু চেনা লোকগান শোনান। রাত ঠিক ১১টায় মঞ্চে আসে ভারতের পাঞ্জাবের ওয়াদালি ব্রাদার্স গানের দল। তাদের গানে দর্শকদের হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়েই শেষ হয় প্রথম দিনের আয়োজন।

সান কমিউনিকেশনের পরিচালনায় চতুর্থবারের এ আয়োজন ছিল বেশ গোছানো, সুশৃঙ্খল। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল ও সংগীতা আহমেদ।