চোখের সামনে আড়াই হাজার বছর

প্রত্ননাটক মহাস্থান–এর দৃশ্য। ছবি: সোয়েল রানা
প্রত্ননাটক মহাস্থান–এর দৃশ্য। ছবি: সোয়েল রানা
>প্রায় দুই বছরের প্রস্তুতির পর গত শুক্র ও শনিবার মহাস্থানগড়ের বাসু বিহারে সফলভাবে মঞ্চস্থ হয় প্রত্ননাটক মহাস্থান। সাড়ে তিন শ শিল্পীসহ দুই হাজার কলাকুশলী নিয়ে মঞ্চস্থ নাটক ঘিরে বগুড়ায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বগুড়া ঘুরে এসে লিখেছেন মাসুম আলী

রুপার থালার মতো চাঁদ; চন্দ্রাতপ মহাস্থানগড়ের লাল মাটির বুকে ঠায় নেওয়া উঁচু–নিচু বাসু বিহারে। এখানেই উৎসবে মেতেছিল অগণিত মানুষ। এ উৎসব নাটকের। এখানে বাঁধভাঙা বন্যার স্রোতের মতো মানুষ এসেছিল। সন্ধ্যার পর দুই ঘণ্টা তাঁরা দেখেছিল আড়াই হাজার বছর পথ পাড়ি দেওয়া দিনগুলোকে।

আড়াই হাজার বছরের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে এ প্রত্ননাটক মহাস্থান দারুণ সাড়া ফেলেছিল গত শুক্র ও শনিবার (২৩ ও ২৪ নভেম্বর)। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনায় এ নাটক ছিল স্থানীয় দর্শকের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। শুধু স্থানীয় বললে কম বলা হবে, আশপাশের অঞ্চলের অগণিত মানুষ শামিল হয়েছিল নাটক দেখতে। ঢাকা থেকেও গিয়েছিলেন নাটকের জগতের চেনা–জানা মানুষেরা।

সন্ধ্যা ছয়টায় নাটক, অথচ প্রথম দিন শুক্রবার দুপুর থেকেই বাসু বিহারের চারপাশ থেকে নানা বয়সী নারী-পুরুষের আসা দেখেই আঁচ পাওয়া গেল কতটা আগ্রহ তৈরি করেছে আয়োজনটি। রীতিমতো বাহারি পণ্যের মেলা বসে যায় নাটকের প্রদর্শনীকে সামনে রেখে। নাটক উপলক্ষে দূরের আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করে নিয়ে এসেছেন, এমন ঘটনাও দেখা গেছে। সন্ধ্যায় দর্শক সারিতে বসা বা দাঁড়িয়ে থাকার মতো কোনো জায়গা ছিল না। গাছের ডালে চড়ে, কাছাকাছি বাড়ির টিনের চালে বসে যে যেভাবে পেরেছে চোখ রেখেছে বাসু বিহারের মধ্যে। দূরে শব্দ বিতরণের ব্যবস্থা তো ছিলই, ছিল বড় পর্দায় নাটকের সরাসরি প্রদর্শনের ব্যবস্থা। উৎসুক অগণিত জোড়া চোখের সংযোগ সেখানেও ছিল।

নাটকের শুরুতে নেপথ্য থেকে ভেসে আসে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের ভরাট কণ্ঠ। ‘আমি মহাস্থান’ নিজেকে ‘মহাস্থান’ আখ্যা দিয়ে বর্ণনা করেন এর ইতিহাস। মূলত নাটকের সারাংশ শোনা গেল তাঁর নিপুণ পাঠে। একে একে নানা দিক থেকে আসেন সাড়ে তিন শ শিল্পী। তাঁদের পোশাক, শরীরের ভাষা আর সংলাপে আড়াই হাজার বছরের বিভিন্ন সময়ের শাসন–শোষণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। শিকার যুগ থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ, রামায়ণের গীত থেকে কালিদাসের কাব্য, চর্যাপদ, সুফিগান, লোকগান; ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাস মিলল নাটকে।

নাটক শেষে দর্শকের সামনে যখন শিল্পীরা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন অনেকের চোখ ছিল ভেজা। নির্দেশক লিয়াকত আলী ভেজা চোখে প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁদের ৩৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে এ নাটকে। তাঁর নাট্যজীবনে মহাস্থান নাটকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এত বড় এবং এমন বিচিত্র প্রযোজনার অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাস-ঐতিহ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি আমাদের যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের আলোকিত অধ্যায় রয়েছে, সেটাই মহাস্থান নাটকে দেখিয়েছি। নাটক শেষে দর্শকের মনে হয়েছে, আমরা গর্বিত জাতি।’