যে খাটে জয়ার জন্ম তাতেই রানুর মৃত্যু

>একেকটা সিনেমার একেকটা চরিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানান স্মৃতি, নানান গল্প। জয়া আহসান অভিনীত ও প্রযোজিত দেবীও তেমন একটি ছবি। এরই মধ্যে অনেকেরই হয়তো জানা হয়ে গেছে যে সরকারি অনুদানে নির্মিত এ ছবি জয়া প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র। তাই দেবীর পরতে পরতে মিশে আছে জয়ার আবেগ আর রানু চরিত্রটির প্রতি গাঢ় ভালোবাসা। দেবী ছবির ‘রানু’ চরিত্রটি নিয়ে প্রথম আলোর আনন্দ–তে সেই আবেগ আর ভালোবাসায় মাখা ৫টি গল্প লিখেছেন জয়া আহসান
জয়ার জন্ম এই খাটে
জয়ার জন্ম এই খাটে

রানুর পালঙ্ক

দেবী ছবিতে রানুর শোবার ঘরের খাট, বিশেষ করে এ চরিত্রের পরিণতি ঘটে যে খাটে, সেখানেই আমার জন্ম হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, এই একই খাটে আমার মা রেহানা মাসউদের জন্ম। অবশ্য শুধু আমি কিংবা মা নন, পাঁচটি প্রজন্ম এই খাটে জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠেছে। মূলত এই খাট আমার মায়ের দাদার দাদার, ব্রিটিশ আমলে তৈরি। সে সময় এটি অবশ্য বিশাল আকারের উঁচু পালঙ্ক ছিল। আমার মা–খালাদের জন্মের সময় পালঙ্ক কেটে কিছুটা ছোট করা হয়, যাতে তারা এতে নিরাপদে খেলতে পারে, খুব উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা না পায়। মা যখন ছোট ছিলেন, তখন নাকি আম খেতে খেতে সেই খাটের নিচে ঘুমিয়ে পড়তেন। আমাদের ভাই-বোনদের জন্মের পর খাটটি আরেক দফা কেটে ছোট করা হয়। আমরা খালাতো-মামাতো ভাইবোনেরা সেই খাটের গোল নকশাগুলোকে গাড়ি বানিয়ে খেলতাম। কত স্মৃতি যে আছে এই একটি খাট ঘিরে। অলৌকিক শক্তি আছে কি না জানি না, তবে এই খাটে গা এলিয়ে দিলে প্রায়ই রাজ্যের ঘুম চলে আসে। মন খারাপ কিংবা ঘুম না আসার মুহূর্তগুলোতে এই খাট অদ্ভুত প্রতিষেধকের মতো, জাদুর মতো কাজ করে। ক্লান্তি দূর করে দেয়। শুটিং শুরুর আগে ব্যক্তিগত প্রস্তুতির সময় বরাবরই একটা ব্যাপার মেনে চলি আমি, যখন যে বাড়িতে বা সেটে শুটিং হবে, সম্ভব হলে সে বাড়িতে শুটিংয়ের আগে চলে যাই কিংবা শুটিং শুরু হওয়ার খানিক আগে ওই বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাই, যেন অভিনয়ের সময় বিশ্বাস করতে অসুবিধা না হয় যে সেটা আমার চরিত্রের বাড়ি। দেবীরজন্য সেটি আমাকে করতে হয়নি। এই একটি খাট আমার কাছে অদ্ভুত এক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। অবশ্য শুধু খাটই নয়, খাটে ব্যবহৃত চাদর, বালিশ, তোশক, কাঁথা—সবকিছু আমার ব্যক্তিগত আবেগের জায়গা, আমার নানুর হাতে সেলাই করা, তাঁর স্পর্শ লেগে আছে ওসবে। দেবীররানুর মতো আমার নানু আনোয়ারা বেগমও এই খাটে মারা গিয়েছিলেন। নানু সব সময়ই আমার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলেন। এখনো আছেন। আর সে কারণেই দেবী চলচ্চিত্রটি আমার নানুকে উৎসর্গ করেছি।

জয়া পরেছেন মায়ের শাড়ি
জয়া পরেছেন মায়ের শাড়ি

রানুর শাড়ি

এই চলচ্চিত্রে আমি আমার নানু ও মায়ের বেশ কিছু শাড়ি পরেছি। মিসির আলি গ্রাম থেকে ফেরার পর যে দৃশ্যে রানুর মুখোমুখি হয়, সে দৃশ্যে রানুর হলুদ ব্লাউজের সঙ্গে পরা কালো জরির পাড়ের মেরুন শাড়িটি আমার মায়ের। মা যখন অন্তঃসত্ত্বা, তখন ‘সাধ’ অনুষ্ঠানে আমার নানু এই শাড়ি মাকে উপহার দিয়েছিলেন। আরেকটি দৃশ্য আছে, যেখানে নীলুর সঙ্গে ক্যাফেটেরিয়ায় যায় রানু। সে দৃশ্যে আমার পরনের শাড়িটিও মায়ের। আমার জন্মের আগে ১৯৭২ সালের দিকে মাকে আমার নানা শাড়িটি কিনে দিয়েছিলেন। মা তখন হলিক্রস স্কুলে পড়তেন। সিল্কের সেই শাড়িটি ছিল আমার মায়ের জীবনের প্রথম শাড়ি। অবশ্য শুধু মায়েরই নয়, আমার জীবনে পাওয়া প্রথম শাড়িটিও আমি এই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছি। ‘দুমুঠো বিকেল’ গানে পরেছিলাম। শাড়িটি টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির থেকে কিনে নানু আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এ রকম ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা আরও বেশ কিছু প্রিয় শাড়ি এ ছবিতে ব্যবহার করেছি।

‘দুমুঠো বিকেল’ গানে জয়া
‘দুমুঠো বিকেল’ গানে জয়া

রানুর গয়না ও লুক

দেবী চলচ্চিত্রে পোশাক ও গয়না নির্বাচন করার ক্ষেত্রে এ সময়ের তরুণ পোশাক পরিকল্পনাকারী আনিকা জাহিন আমাকে অকৃত্রিম সহযোগিতা করেছেন। মুঘল চিত্রকর্মে নারীদের যেমন অবয়ব থাকে, কখনো মনে হয় ছবি থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসছে, কখনো মনে হয় একেকটি অভিব্যক্তিতে বহুরূপ; আমরা সবাই চেয়েছিলাম ‘রানু’র মধ্যেও সেই রহস্য কিছুটা খেলে যাক। এ জন্য একটু ঢেউখেলানো চুল, পুরোনো আদলের শাড়ি, গয়না ব্যবহার করেছি। ‘দুমুঠো বিকেল’ গানে পরা রুপার গয়নাগুলোও আমি নিজে স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় কিনেছিলাম। আড়ং কিংবা আলোহা থেকে গয়না কিনতাম। সেই গয়নাগুলো এবার ব্যবহার করেছি। মায়ের সংগ্রহশালা থেকে তাঁর নাকফুল পরেছি।

রানুর ঘরে জয়া
রানুর ঘরে জয়া

রানুর ঘর

তরুণ প্রজন্মের বোধগম্য করার জন্য আমাদের পরিচালক অনম বিশ্বাস ২০১৮ সালের প্রেক্ষাপটে দেবী চলচ্চিত্রের গল্প সাজিয়েছেন। তবে আমরা শুরু থেকেই চেয়েছি, হুমায়ূন আহমেদ যে সময়ে গল্পটি লিখেছিলেন (১৯৮৫), সেই আশির দশকের আবেগ-অনুভূতিও যাতে পর্দায় অক্ষুণ্ন থাকে। সে ভাবনা থেকেই রানুর সেলাই মেশিন থেকে শুরু করে আরও অনেক অনুষঙ্গ নিজের ঘর থেকেই নিয়ে এসেছিলাম। প্রযোজক হিসেবে খরচও বেঁচেছিল আমার, আবার গল্পের সঙ্গেও সমান্তরালে চলতে পেরেছিলাম। তা ছাড়া রানু-আনিসের ঘরটিতে কিছুটা আশির দশকের ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা। রানু যেহেতু অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো ধারণ করে, তাই তার ঘরে কিছুটা সবুজাভ, কিছুটা আবদ্ধ একটা অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা ছিল। যাতে দর্শকের মস্তিষ্কে কিছুটা হলেও চাপ পড়ে। পুরোনোকে আঁকড়ে ধরার এক অদম্য নেশা আছে আমার। ভালো লাগার, ভালোবাসার বিষয়গুলো যত বড়ই হোক কিংবা ছোট, আমি সংরক্ষণ করি। স্বর্ণখচিত জরি দিয়ে মায়ের ময়ূরকণ্ঠী রঙের বিয়ের শাড়িটা আমি বাঁধাই করে আমার সংগ্রহে রেখে দিয়েছি। আমার কাছে মা-নানুদের মসলিন শাড়িও আছে, যা ভাঁজ করে রীতিমত আংটির বাক্সে ঢুকিয়ে রাখা যায়। মায়ের কোন শাড়ি কে পরব—তা নিয়ে আমি আর আমার বোন কান্তা প্রায়ই ঝগড়া করি। কারণ আপাতদৃষ্টিতে এই শাড়ি, গয়নাগুলো আমাদের কাছে দলিল, কালের সাক্ষী।

রানুর দৃশ্যগুলোয় দেখা যায় রক্তজবার উপস্থিতি
রানুর দৃশ্যগুলোয় দেখা যায় রক্তজবার উপস্থিতি

রক্তজবা

জবা ফুল নিয়েও মজার কিছু গল্প রয়েছে। রক্তজবা আমার ভীষণ পছন্দের ফুল। তাই শুধু চলচ্চিত্রের ভেতরেই নয়, আমাদের প্রচার-প্রচারণায়, লোগোতে, এমনকি দেবীর শাড়িতেও আমরা জবা ব্যবহার করেছিলাম। পরিচালক অনম বিশ্বাস যখন দেবীরলোগোতে রক্তজবা ব্যবহার করলেন, তখন থেকেই তিনি চাইছিলেন রানুর দৃশ্যগুলোতেও যেন রক্তজবার উপস্থিতি থাকে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, আমাদের শিল্প নির্দেশক সে সময় সাদা জবা, গোলাপি জবাসহ নানান রঙের জবা গাছ কিনে আনলেও কোথাও রক্তজবা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বাধ্য হয়ে জবা বাদ দিয়েই শুটিং শুরু হবে ঠিক হলো। কিন্তু আমার মন কেন জানি কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। হয়তো প্রকৃতি আমার এই অস্থিরতা মেনে নিতে পারেনি। ভাগ্য সহায় হলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম, অন্যদের সাহায্যের শরণাপন্ন হচ্ছি কেন? আমার বাড়ির ছাদবাগানেই তো বেশ বড় রক্তজবা গাছ আছে! এটা মনে পড়তেই সেদিন কী যে আনন্দ হয়েছিল! তারপর সেই রক্তজবা গাছটিই পুরো ছবিতে ব্যবহার করা হলো। এখনো ভীষণ লাল রক্তজবা ফোটে গাছটাতে। অদ্ভুত এক মায়ার বাঁধনে গাছটি জড়িয়ে রেখেছে আমাদের সবাইকে।

দেবী ছবির পোস্টার
দেবী ছবির পোস্টার

একনজরে ‘দেবী’
পরিচালক
অনম বিশ্বাস
মুক্তি
১৯ অক্টোবর ২০১৮
চিত্রানট্য
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস দেবী অবলম্বনে লিখেছেন অনম বিশ্বাস
প্রযোজনা
সরকারি অনুদান ও সি-তে সিনেমা
অভিনয়ে
জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, শবনম ফারিয়া, অনিমেষ আইচ, ইরেশ যাকের প্রমুখ