রিয়্যালিটি শোয়ে ছেলে-মেয়েদের নষ্ট করা হয়

>ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার শিল্পী। তবে তাঁর নানা ও দাদাবাড়ি বাংলাদেশে। পঞ্চকবির গানের জন্য পরিচিত তিনি। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টায় তিনি গাইবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে। একই মঞ্চে তাঁর সঙ্গে গাইবেন নাটকের গানের জন্য কলকাতার আরেক খ্যাতিমান শিল্পী দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বামী-স্ত্রী একত্রে ঢাকার মঞ্চে গাওয়া আর ঢাকা সফর নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়

কেমন আছেন? কোথায় উঠেছেন?
ভালো আছি। এবার উঠেছি রামেন্দুদার বাসায়। এখানে এত যত্ন হয় যেন নিজের বাড়িতে আছি।

ঢাকায় এসে এবার কী কী খেলেন?
ঢাকায় আসার পর থেকে তো খেয়েই যাচ্ছি। ফেরদৌসী (ফেরদৌসী মজুমদার) আপুর যত্ন ও রান্না তো বিখ্যাত। শুঁটকি খেলাম। সোহাগের ওখানে খেলাম কালোজিরা ভর্তা, শিম ভর্তা, বিরিয়ানি বা মাংস ভুনা তো আছেই। তবে আমার ভর্তা ভালো লাগে। ফেরদৌসী আপা নিজেই সব ভর্তা করলেন। তাঁর কাছে এলে কোনো না কোনো একটা রান্না শিখে যাই। যেনে নিই যে কোনটা কীভাবে করেন তিনি। এর মধ্যে বন্ধুবান্ধব দাওয়াত দিয়েই যাচ্ছে। কাল আবার একজন কালাভুনা খেতে ডাকল।

তো এবার কী রান্না শিখলেন?
ফেরদৌসী আপু আলু আর পেঁয়াজ দিয়ে খুব সুন্দর করে বেলে মাছ রান্না করেন। আমাদের ওদিকে মাছের গন্ধ দূর করতে মাছ কড়া করে ভেজে রান্না করা হয়। কিন্তু এখানে মাছে কোনো কাঁচা গন্ধ থাকে না।

আজকের অনুষ্ঠানে ব্যতিক্রম কী থাকবে?
ব্যতিক্রম কিছু একটা তো থাকবেই। গতানুগতিক অনুষ্ঠান করব কেন? মঞ্চে উঠে গেয়ে চলে গেলাম এমন অনুষ্ঠান আমি করি না। প্রতিটি গান নিয়ে একটু করে গল্প করব, গান সম্পর্কে বলব। এ জন্য নিজেকে সব সময় আপ–টু–ডেট রাখতে হয়, পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হয়। গল্পটা বললে হয় কি, গানটির একটা ছবি তৈরি হয়ে যায়। তবে অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু যেহেতু ‘আলোছায়ার গানগুলি’, এখানে একটা ভাবনা আছে। যেমন ছোটবেলা থেকে যে গানগুলো শুনে আমরা বড় হয়েছি, সেগুলোর অনেক গানই হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন হিমাংশু দত্তের গান, বাংলা নাটকের যেমন গিরীশচন্দ্র ঘোষের গান, উৎপল দত্তের গান। তা ছাড়া বাংলাদেশের নাটকের গান যেমন থিয়েটারের গান গাইব, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দলের নাটকের গানও থাকবে।

দেবজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে গান করা কমিয়ে দিলেন কেন?
এখন দুজনের দুই দিকে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। এ কারণেই দুজনের একসঙ্গে গান করা হয় না। একসময় করতাম। এখন আমি একটা ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করি। মনে আছে, একবার ভারতের কেরালায় সংগীত নাটক একাডেমির একটা অনুষ্ঠানে দুজনে একত্রে গেয়েছিলাম। অনুষ্ঠানটা খুবই ভালো হয়েছিল। কলকাতায় যখন দুজন গাইতাম টিভি বা মঞ্চে, শ্রোতাদের মধ্যে একটা উন্মাদনা কাজ করত। কারণ, আমাদের পরিচিতিই ছিল দেবজিত্-ঋদ্ধি জুটি হিসেবে। ঢাকার কথা আলাদা। আমরা প্রতিটি শিল্পীই স্বীকার করি যে বাংলাদেশে গান করে যেমন সাড়া পাই, পৃথিবীর কোথায় তেমনটা পাই না। বিদেশে গান করতে গেলে, সেখানেও বাংলাদেশের শ্রোতাই বেশি পাই। বাংলাদেশটা আর এক কারণে আমার ভালো লাগে। এখান থেকে প্রচুর শাড়ি কিনতে পারি।

ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়

এই বাংলার শিল্পীদের কণ্ঠে পঞ্চকবির গান শুনেছেন?
খুব একটা শোনা হয়নি। পঞ্চকবির গান গাইতে শুরু করি ২০১১ সালে। তখন অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের গান করতেন। সে সময় রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও অতুলপ্রসাদ সেনের গান প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল। কিন্তু এখন যেটা দেখতে পাই, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীরা অতুলপ্রসাদ সেনের গান করছেন, দ্বিজেন্দ্রলালের গান করছেন। আমার মনে হয় প্রতিটি গানের একটা নিজস্ব ধারা আছে। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন রবীন্দ্রনাথের মতো গাওয়া উচিত, তেমনি অন্য কবিদের গানও তাঁদের মতো গাওয়া উচিত। যাঁরা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, তাঁরা অতুলের গান করলে রবীন্দ্রসংগীতের ধাঁচে গাইছেন বলে মনে হয়। আমাদের শিল্পীদের মনে রাখা দরকার, গান যেন তাঁর কণ্ঠের মধ্য দিয়ে তার চরিত্রটা হারিয়ে না ফেলে। আবার আধুনিক গানের শিল্পী যদি রবীন্দ্রনাথের গান আধুনিক ভঙ্গিতে গায়, তাহলে তো হয় না। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, গান তোলার জন্য ইউটিউব নয়, সঠিক গুরুর সন্ধান করতে হবে। আমি যদি কখনো লালনের গান করতে চাই, কুষ্টিয়ার কোনো লালন গানের গুরুর কাছ থেকে শিখে নিয়েই করতে চেষ্টা করব। গান তোলা ও শেখা কিন্তু এক কথা নয়।

কলকাতার অনেক ছবিতে কিন্তু সুর বদলে গান চালাতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে কী বলবেন?
আমি একে খুব খারাপ চোখে দেখি। লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যেভাবে তাঁদের গানটি লিখে গেছেন, যেভাবে সুর করে গেছেন, সেটাকে নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। ফিউশন করতে গিয়ে কনফিউশন তৈরির পক্ষপাতী নই আমি। বরং নিজে গান লিখে সুর করে ধ্বংস করুক।

রিয়্যালিটি শোগুলোতে তাহলে কী হচ্ছে?
আমি রিয়্যালিটি শোতে বিশ্বাস করি না। আমার কাছে রিয়্যালিটি শোর বিচারক হওয়ার অনেক অফার আসে, আমি যাই না। নিজেদের ব্যবসায়িক লাভের জন্য রিয়্যালিটি শোতে ছেলে-মেয়েদের নষ্ট করা হয়, গানগুলোকেও নষ্ট করা হয়। লোকগানের যে রস, রূপ, সৌন্দর্য আছে, সেই জিনিসটা না বুঝলে, সেই ব্যাপারটা গলায় না এলে, গলাটা শুদ্ধ ও পরিশীলিত না হলে লোকগান গাওয়া ঠিক না। এসব নিয়ে ভাবা উচিত। নিজের কাজের প্রতি একটু নিষ্ঠা ও সততা থাকলে আর এসব হবে না। যদিও নিষ্ঠা জিনিসটা এখন কোথাও নেই। সমস্ত জায়গায় নিষ্ঠা হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

আপনার লেখালেখির কী অবস্থা?
লেখার ব্যাপারে আমি খুবই কুঁড়ে। প্রকাশকেরা নিয়মিত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। পতিতাপল্লির মেয়েদের নিয়ে যে কাজ করছি, সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে দুই-তিনটা বই হয়ে যায়। একটা বই শেষ করতে আমার এক বছর লেগে যায়। অতুলপ্রসাদ সেনকে নিয়ে বইটা হয়তো ২০১৯ সালের বইমেলায় হবে না। বৈশাখে হয়ে যেতে পারে। অনুষ্ঠানের চাপ এত বেশি যে লেখার সময় পাই না। লেখালেখি খুব সিরিয়াস একটা কাজ।