ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপনে দ্বিজেন্দ্রলালের গান!

বিজ্ঞাপনচিত্রের অভিনেতা ও শিল্পীদের কঠোর সমালোচনা করে ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছেন পৌলোমী
বিজ্ঞাপনচিত্রের অভিনেতা ও শিল্পীদের কঠোর সমালোচনা করে ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছেন পৌলোমী

পঞ্চকবির অন্যতম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর একটি খুব জনপ্রিয় গানের কথা বিকৃত করে নির্মিত হয়েছে বিজ্ঞাপনচিত্র। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে সেই গান। বিজ্ঞাপনচিত্রের অভিনেতা ও শিল্পীদের কঠোর সমালোচনা করে একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের পৌলোমী নামের এক তরুণী। ফেসবুকে সেই ভিডিওটি এখন ভাইরাল।

বিজ্ঞাপনচিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এ বসুন্ধরা’ গানটি। সুর ঠিক রেখে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনে বদলে দেওয়া হয়েছে গানের কথা। ভিডিওটিতে আক্ষেপ করে তরুণী বলেন, ‘এর নির্মাতা, অভিনেতা, শিল্পী সবাই সফল, শিক্ষিত, জনপ্রিয়। কিন্তু এ রকম একটি গানের কথা বদলে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে তাঁদের বিবেক বাধা দিল না?’ এমনকি সুমন, চন্দ্রিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপিকে এ নিয়ে প্রতিবাদ না করায় দুষলেন এই তরুণী। তিনি আরও বলেন, ‘এ গান বিকৃত করলে তাঁদের কিছু যায়-আসে না, বরং মধ্যবিত্ত ঘরের বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েদের যায়-আসে।’

বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল অনির্বাণ ভট্টাচার্যের উদ্দেশে ভিডিওচিত্রে বলা হয়েছে, ব্যোমকেশ বকশির মতো চরিত্রে অভিনয় করা থিয়েটারকর্মী অনির্বাণ কীভাবে পারলেন এমন একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করতে? অভিনেত্রী সোহিনী সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘“ফড়িং” সিনেমায় আপনার অভিনয় অনবদ্য। এরপর “ওপেনটি বায়োস্কোপ”, “দুর্গা সহায়”, “বিবাহ ডায়েরি”র মতো ছবিতে কাজ করে আপনি প্রমাণ করেছেন একজন বুদ্ধিদীপ্ত অভিনেত্রীর বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কতটা দরকার ছিল। তারপরও আপনি এ ধরনের একটা কাজ করলেন? আপনি ভেবেছিলেন বাংলার মানুষ এসব ভুলে যাবে? বাংলার মানুষ তো মিরজাফরকেই এখনো ভুলতে পারেনি। তাঁরা যদি ক্ষেপে যায়, আপনার এত ভালো সিনেমাগুলোর একটারও টিকিট বিক্রি হবে না।’

সব শেষে তরুণী কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন ড. বাসুদেব মুখার্জির। বলেছেন, ‘আপনি সফল অভিনেতা, গাইনোকোলজিস্ট। আপনার টাকার অভাব? টাকার জন্য এমন একটা গানকে বিক্রি করে দেওয়া যায়, যে গান বাচ্চারা স্কুলে প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে গায়? নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও বিজ্ঞাপনের গায়ক শ্রীকান্ত আচার্য, সামন্তক সিনহা ও সোমলতা আচার্যের সমালোচনা করা হয়েছে ওই ভিডিওতে।

আলোচিত বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃশ্য
আলোচিত বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃশ্য

এরপর বিজ্ঞাপনের এ গান নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা সৃজিত মুখোপাধ্যায় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় প্রথম গায়ে কাঁটা দিয়েছিল আর চোখে জল এসেছিল এই গানটা প্রেয়ার হলে গেয়ে। যদিও অনেক শিক্ষিকা বলেছিলেন, একই দেশপ্রেম অনেক কম কথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “সার্থক জনম আমার” গানটাতে ব্যক্ত করেছেন। তাও আমার কাছে অনেক বেশি প্রিয় ছিল এই গান, এই গানে ঢেউয়ের মতো একের পর এক স্তবক এসে মনকে ধুয়ে দেশপ্রেমের সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই গানের শরীরে সুইমিং পুল, শপিং মল, পাঁচ লাখ ইত্যাদি শব্দ কেন জানি না বহু পুরোনো স্মৃতির মধ্যে জং ধরা পেরেকের মতো বিঁধল। কষ্ট হলো। ধনুষ্টঙ্কারে একটা ছোটবেলার মৃত্যু অবধারিত।’

অভিনেতা ঋদ্ধি সেন লিখেছেন, কিছুদিন আগে এটা দেখে নির্বাক হয়ে গেলাম। ডন ম্যাকলেনের এই কথাটা সত্যি, ‘দে ডিড নট লিসেন, দে আর নট লিসেনিং, পারহ্যাপস দে নেভার উইল।’

ভিডিওটির বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র লিখেছেন, ‘ভেবেছিলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করব না। নিজেকে আটকাতে পারলাম না। বিজ্ঞাপনটি আমারও ভালো লাগেনি। তবে শিল্পীদের এভাবে অপমান করা কোন সভ্যতায় পড়ে? আপনি নিজের জীবনে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেননি? অন্যায় করেননি? ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত পরের কথা। সিদ্ধান্তে ভুল কে না করে? তা বলে এত দিন ধরে ভালো কাজগুলো একদিনে নস্যাৎ হয়ে গেল?’

লোপামুদ্রা মিত্র আরও লিখেছেন, ‘আরেকটা কথা, দেশের চারদিকে যা ঘটছে, গান-বাজনা করে খাই আমরা, যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই দিনের পর দিন, তা কতটুকু খবর রাখেন আপনারা? তখন কোথায় থাকেন আপনারা? অবমাননা হয়েছে। ১০০০ ভাগ সত্যি। যাঁরা ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন, শুধু বাড়িতে বসে ফেসবুক দেখে আর টেলিভিশন দেখে, নিজের রাজ্য, নিজের ভাষা, দেশ, কোনটা বাঁচানোর কাজ করেন আপনারা? সব দায় শুধু শিল্পীদের?’

ভিডিওতে মন্তব্যকারীদের অন্যতম অনুপম বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক ভারতীয় লিখেছেন, ‘ব্যস, সুযোগ পেলেই বাঙালির শুরু যায় সেন্টিমেন্টাল কাঁদুনি এবং মর‌্যাল পুলিসিং! যেন পয়সা কামানো, বিপণন করা অপরাধ। বেশ করেছে, বিজ্ঞাপনটা করেছে! আজ নয়, বঙ্কিম বাবুর আমল থেকে এই সব চলে! উনিশ শতকে হিন্দু পত্রিকায় “বঙ্কিম বানর” কার্টুন এঁকে বঙ্কিম বাবুকে উপহাস করা হয়েছিল! সেই দ্বিজেনবাবুকে নিয়ে এত মাতামাতি করেছেন ভদ্রমহিলা, সেই দ্বিজেনবাবু ঈর্ষাবশত বহুবার রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ করেছেন! হ্যাঁ পাবলিকলি! জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কুরুচিকর প্যারোডি করেছেন! ভদ্রমহিলা এমন ভাব করছেন যে বিজ্ঞাপনটি না করলে তিনি গিয়ে শিল্পীদের পারিশ্রমিক দিয়ে আসতেন! যা-ই হোক বিজ্ঞাপনের দিক দিয়ে বলতে গেলে, ১. কোনো আইন ভাঙা হয়নি, দ্বিজেন্দ্রলাল কপিরাইটেড নন! ২. দেশে বিল অব রাইটস এবং ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন বলে একটা সংসদীয় অধিকার আছে! ৩. কেউ রেপড হয়নি! কোনো থ্রেট মেসেজ বা হেট্রেড ছড়ানো হয়নি! ৪. বিজ্ঞাপন না করার জন্য কেউ শিল্পীদের কাউন্টার অফার দেয়নি! ৫. টাকা কামানো কোনো অপরাধ নয়! ৬. সব শেষে, চটকদার বিজ্ঞাপন করা হয় ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য, সেদিক দিয়ে বিজ্ঞাপনটি সফল!