'বাংলাদেশ স্বাধীন': যেভাবে ঘোষণাটি দেওয়া হয় রেডিও-টিভিতে

ফতেহ আলী চৌধুরীর প্রথম ঘোষণা
ফতেহ আলী চৌধুরীর প্রথম ঘোষণা

সামনে বসে আছেন হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। আমরা এসেছি তাঁর কাছ থেকে ওই সময়ের কিছু গল্প শুনতে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হবে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বরের ঘটনা শুনতে এসেছি। সেদিন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন’।

আমরা কথা শুরু করি। তার আগে তিনি ব্রেভ অব হার্ট নামে একটি বই হাতে দেন। বইটি তাঁরই লেখা। এত বড় ঘটনা, এত কিছুর সাক্ষী এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কথার খেই হারিয়ে ফেলি। পরে বিষয় বলে দিলে গল্পটা তিনিই শুরু করেন।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। ১৭ ডিসেম্বর ভোর চারটায় হাবিবুল আলম ছিলেন নারিন্দাতে। সেখানে তাঁরা জানতে পারেন, আত্মসমর্পণের এক দিন আগে পাকিস্তানি বাহিনী বিহারি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু অস্ত্র ও গোলা বিতরণ করেছে। পরে এর ভিত্তিতে সেখানে অপারেশনে নেমেছিলেন তাঁরা। সেই ঘটনা মনে করে বলেন, ‘জানতে পারি, ভারতীয় মিত্রবাহিনী আজ (১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১) রেডিও বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেবে। একই সঙ্গে সকাল আটটা বা সাড়ে আটটার দিকে বেতার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হবে। খবরটা শোনার পরপরই খারাপ লাগে। মনে হয়, ভারত থেকে আমাদের প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে একজন বিদেশি আমাদের স্বাধীনতার কথা প্রচার করবেন? এর চেয়ে আমাদের জন্য অবমাননাকর আর কী আছে। ওই সময়ই সিদ্ধান্ত নিই, কাজটা আমাদেরই করতে হবে। সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে বসে বিষয়টি ভাবতে লাগলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা সেক্টর কমান্ডার অথবা মুজিবনগর সরকারের কোনো প্রতিনিধি ছাড়া এই ঘোষণা অন্য কাউকে করতে দেব না। কাজেই সঠিক ব্যক্তি না পাওয়া অবধি রেডিও সেন্টার দখলে রাখতে হবে। এটা চিন্তা করেই ভোর হওয়ার আগে নারিন্দা ছাড়লাম আমরা।’

বন্ধ নয়, চালু হলো রেডিও
‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেডিও বন্ধ ছিল।’ গল্প এগিয়ে চলে আমাদের। হাবিবুল আলম বীর প্রতীক জানান, নারিন্দা থেকে বের হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চিন্তা করেন দ্রুত শাহবাগের রেডিও স্টেশনে যেতে হবে। কিন্তু গিয়ে দেখেন পুরো কার্যালয় বন্ধ। একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় রেডিও চালু করার ব্যাপারে কোথায় কথা বলতে হবে। তিনি পাশে চায়ের দোকানে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ পিয়নকে দেখিয়ে দেন। হাবিবুল আলম গাড়ি রেখে সেই চায়ের দোকানে যান। ততক্ষণে তাঁর কাছের বন্ধু সহযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরীও চলে এসেছেন। পিয়ন বলেন, রেডিও চালানোর বিষয়ে খুঁটিনাটি জানেন তৎকালীন আঞ্চলিক পরিচালক শামসুল হুদা চৌধুরী। তাঁর বাসা পাশেই ইস্কাটন গার্ডেনে।

এরপর দেখা যায় মেজর হায়দারকে
এরপর দেখা যায় মেজর হায়দারকে

দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে ফতেহ আলী ও হাবিবুল আলম রওনা দেন সেখানে। বাড়ির সামনে গিয়ে হর্ন দেন। তখন সকাল ছয়টার মতো বাজে। তাঁরা উঠে যান তিনতলায়।
মুক্তিযোদ্ধারা এসেছেন শুনে দ্রুত ভেতরে নিয়ে বসতে দেওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন শামসুল হুদা চৌধুরী। খানিক পর তাঁর স্ত্রী সংগীতশিল্পী আরজুমান্দ বানু আসেন চমচম হাতে। মুক্তিযোদ্ধারা এসে মিষ্টিমুখ না করে যাবেন নাকি! তাও বিজয়ের পরের দিন!
চমচম খেলেন ঠিকই। কিন্তু আসল কাজ তো করতে হবে।
হাবিবুল আলম বলেন, ‘আমার কাছে পিস্তল ছিল। ফতেহর কাছেও। সেটা বের করে টেবিলে রাখি। আমি হুদা সাহেবকে বলি, আপনার জন্য এখন দুটো সুযোগ। হয় আপনাকে রেডিওটা খুলে দিতে হবে, না হয় মরতে হবে। তিনি কয়েকটা জায়গায় ফোন করার সুযোগ চান। তিনি উঠে ফোন করতে গেলে আমরা অপেক্ষা করি। তিনি এসে বলেন, সময়মতো খুলে যাবে। তাঁকে বিস্তারিত বলি। আমরা কেন এটা করতে চাইছি। হুদা সাহেব অসাধারণ একটা হাসি দেন। তিনি বলেন, “আপনাদের পথে যদি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে বলবেন, মিরপুর সম্প্রসারণ কেন্দ্রে ক্রিস্টাল রয়েছে। সেগুলো আনতে হবে। আনতে লোক গেছে। সেটা না হলে রেডিও চালু করা সম্ভব নয়।” তাঁর কথা শুনে আমরা ফিরে আসি রেডিওতে।’
তারপর সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যায়। মেজর হায়দার ও শাহাদাত চৌধুরী ঠিক সময়ে রেডিও স্টেশনে পৌঁছান। শাহাদাত চৌধুরী ও কাদের মাহমুদ মেজর হায়দারের বক্তব্য লিখে দেন। নির্দেশ দেওয়া হয়, আটটার আগে যেন কেউ অনুমতি ছাড়া স্টেশনে প্রবেশ না করে।
তবে এই ফাঁকে মিত্রবাহিনীর কয়েকজন রেডিওতে আসেন। শামসুল হুদা তাঁদের কী সব বুঝিয়ে হাসিমুখে বিদায় করেন। আরেক রুমে চলে পুরোদমে অনুষ্ঠানের কাজ।
সকাল ৮টা ১০ মিনিট। শুরুতে ফতেহকে পাঠ করতে বলা হয় বাংলা ঘোষণা। কাচের জানালা দেওয়া স্টুডিওতে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানে আলো জ্বলতেই শুরু হয় ঘোষণা, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং বাঙালিরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক।’ তার পরপরই ঘোষণা দেন মেজর হায়দার। ইংরেজিতে। এরপর চালু হয় বন্ধ রেডিও স্টেশন। শুরু হয় নিয়মিত অনুষ্ঠান।

হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। ছবি: খালেদ সরকার
হাবিবুল আলম বীর প্রতীক। ছবি: খালেদ সরকার

টেলিভিশনে দেওয়া হলো ঘোষণা
ডিআইটি ভবনে ছিল টেলিভিশনের অফিস। রেডিও সেন্টার থেকে বিকেলের দিকে টেলিভিশনে যান হাবিবুল আলম। তাঁর আগে আগে চলে যান ফতেহ আলী চৌধুরী। হাবিবুল আলম ঢুকেই সিঁড়ির গোড়ায় দেখেন স্টুডিও। বাঁ দিকে নিউজরুম। এই সময় দেখা করেন পরিচালক এজাজ আহমেদের সঙ্গে। দেখা হয় খালেদা ফাহমী, সাকিনা আকতার, শিল্পী কেরামত মওলা, এম এ ওয়াহিদ এবং আবদুল্লাহ আল-মামুনের সঙ্গেও। এ সময় সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরী ও মেজর হায়দার।
তাঁদের প্রস্তাব শুনে পরিচালক বলেন, ‘এভাবে তো হুট করে কিছু করা যায় না। কিছু নিয়মকানুন আছে। একটা চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করতে হবে।’
নিয়মকানুন মেনেই সেই ঘোষণা পাঠ করা হয়। তবে পাঠের আগে টেলিভিশনে দেখানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। সেই স্মৃতি মনে করে হাবিবুল আলম বলেন, ‘একটা কাঠের খুঁটিতে পতাকা টাঙানো হয়। পেছনে রাখা হয় একটা টেবিল ফ্যান। সেটা ছেড়ে দিলে পতপত করে উড়তে থাকে পতাকা। স্টুডিওর বিশাল ক্যামেরা দিয়ে সেটা ধারণ করা হয়। তখনই সেটা প্রচার করা হয় টেলিভিশনে। ওই সময় সেখানকার টেবিলে ও তাকে রাখা কয়েকটি রঙিন ও সাদাকালো টিভিতে দেখা যায় সেই পতাকা।’
এই ফাঁকে খালেদা ফাহমীর সঙ্গে বসে শাহাদাত চৌধুরী অনুষ্ঠান চূড়ান্ত করেন। আগের মতোই ফতেহ আলী চৌধুরী বাংলায় ঘোষণা দেন। পরে মেজর হায়দার কিছু নির্দেশনা দেন। তারপর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমান ইংরেজিতে ওই ঘোষণা দেন। হাবিবুল আলম বলেন, ‘এমন একটি ঘোষণার সঙ্গে থাকতে পেরে আমি গর্বিত। বিজয়ের পর এটি আমাদের আরও একটি বিজয়।’