মুক্তিযুদ্ধের অন্তহীন প্রেরণায় আমাদের মঞ্চনাটক
মুক্তিযুদ্ধের নাটক ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ থেকেই লেখা শুরু হয়েছে। জানুয়ারি মাস থেকেই শুরু হয় অভিনয়। মুক্তিযুদ্ধকালের তরতাজা অভিজ্ঞতাই এসব নাটকের বিষয়। নাটকগুলোর মান বেশ দুর্বল হওয়ায় মঞ্চে টেকসই হলো না। তবে বিষয়ের উত্তাপ দর্শককে স্পর্শ করল।
নিয়মিত নাট্যচর্চা শুরু হলো ১৯৭২–এ। সে চর্চায় অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের নাটক খুব একটা দেখা যায়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধের আশাভঙ্গ নিয়ে অনেক নাটক, অণুনাটক রচিত হলো, মঞ্চস্থ হলো। তবে এসব আমাদের নাট্যাঙ্গনে কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। মহিলা সমিতিকেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় প্রথম যে নাটকটি তুমুল আলোড়ন তুলেছিল, সেটি হলো আবদুল্লাহ আল–মামুনের সুবচন নির্বাসনে। সারা দেশের অসংখ্য মঞ্চে অভিনীত হলো এ নাটক। নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তীকালে সমাজ ও মানুষের স্খলন–পতনের কথা বিবৃত হলো নিপুণ নাট্যকুশলতায়। তবে এ নাটকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কোনো ইতিবাচক প্রতিপাদ্য ছিল না। এরপর মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি নাটক সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। নাটকটি ছন্দে রচিত, কাব্যের অভিব্যক্তি আছে, কিন্তু এ নাটকেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোনো ইতিবাচক বক্তব্য নেই। পরে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর নাটক নূরলদীনের সারাজীবন–এ এই বাংলার বীর নূরলদীনের জীবনকে চিত্রিত করলেন অসামান্য নাট্যভাষ্যে। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের একটি মহৎ চরিত্রের নাটক নির্মাণ করে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করলেন তিনি। এরপর আরণ্যক নাট্যদল জয়জয়ন্তী নাটকে একটি পদাবলি কীর্তনের দলকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরে। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক নাটক রচিত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মঞ্চ সাফল্যও এসেছে। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বাইরে বেশ কিছু নাটক মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকেও তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এবং মুক্তিযোদ্ধারা নানাভাবে অনুপ্রাণিত না হলে এ দেশে এভাবে নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠত না।
মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী নাট্যচর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গণতান্ত্রিক নাট্যচর্চা। ১৯৭২ সালে যে জায়গা থেকে নাট্যচর্চা শুরু হয়, সেখানে আধুনিক নাট্যভাবনার ছিল প্রবল প্রভাব। তবে মাথার ওপর চেপে বসেছিল নাটকের সেন্সর প্রথা, যা ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাতিল করে। সত্তরের দশকে নাটকের যে জোয়ার এল, তাতে প্রথম থেকেই সেন্সর না মানার প্রবণতা লক্ষ করার মতো। দেখা যাচ্ছে, এ সময় নাট্যকারেরা কেউ সেন্সর মেনে নাটক লিখছেন না। পঁচাত্তর–পরবর্তী সেনাশাসনের সময়ও এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কোথাও আইনের শাসন নেই, গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, সামরিক শাসনের কালো আইন সবখানে চালু রয়েছে, কিন্তু নাটকের লোকেরা তা মানছেন না। পরে এটা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা জোগায়। এ সময়ে মৌলিক নাটকগুলোতে শ্রেণিসংগ্রাম, বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামী জীবন, স্বৈরাচারবিরোধিতা—এসব খুব জোরালোভাবে স্থান পেয়েছে। যেসব অনুবাদ নাটক অভিনীত হয়েছে, সেগুলোতেও স্বৈরাচার, আমলাতন্ত্রবিরোধিতা এবং গণমানুষের যাপিত জীবন জায়গা পেয়েছে।
নাট্যকার সেলিম আল দীন একটি ভিন্ন নাট্যধারা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি নাটকে বাংলার আবহমানতার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তাঁর নাটকের আখ্যানভাগে এক ভিন্ন জীবন প্রত্যক্ষ করা গেছে। মমতাজ উদ্দিন আহমেদ গণ–অভ্যুত্থানের সময় থেকেই সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে পুঁজি করা প্রতিক্রিয়া শক্তির বিরুদ্ধে নাটক লিখেছেন। এস এম সোলায়মান নাটকে ব্যঙ্গধর্মী সমাজসচেতনতামূলক এক গীতল ধারার সৃষ্টি করে গেছেন। পরে মান্নান হীরা মঞ্চ এবং পথনাটকে জনগণের দুঃখ-বেদনা ও সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। মাসুম রেজা মহাভারতের আখ্যানভাগ থেকে একধরনের নতুন নাট্যক্রিয়ায় সচেষ্ট হয়েছেন। এরপর আজাদ আবুল কালাম
সার্কাস সার্কাস নাটকে মৌলবাদের অপক্রিয়া এবং সাহসী মানুষকে তুলে এনেছেন তাঁর নাটকে। ঢাকার বাইরে অনেক ধরনের কাজ হয়েছে এবং তারাও জাতীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত। রাজশাহীতে মলয় ভৌমিক মৌলবাদের সামনে দাঁড়িয়ে অসাধারণ সব নাট্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের বহু দল সময়োপযোগী আধুনিক নাটকের প্রযোজনা করে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের নাট্য প্রযোজনায় আহমদ ইকবাল হায়দারের ভূমিকা প্রশংসাযোগ্য। গত ৪৬ বছরের নাট্যচর্চায় মুক্তিযুদ্ধের অন্তহীন প্রেরণা আমাদের নাট্যচর্চাকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত করেছে।