মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি এবং আমাদের চলচ্চিত্র

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে খুব কম কাজ করেছি আমি। এর প্রধান কারণ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের অতি আবেগ এবং উন-আবেগ। এই দুইয়ের প্রাবল্যে আমাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকে নির্মোহভাবে দেখা বা বিশ্লেষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা শুধু এইখানে থামলেও মোটামুটি চলত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক লাভালাভের ব্যাপার-স্যাপার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রক্সি যুদ্ধের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সাবজেক্টটা। ফলে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে ছবি করতে মন চাইলেও এই বিষয়গুলো আমাকে পিছু টেনে ধরেছে বহুবার।

কিন্তু শিল্পীর কাজ তো ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েও ঘটনার নির্মোহ বিশ্লেষণ। আমি শিল্পী নই এখনো। হয়ে ওঠার চেষ্টায় আছি বলতে পারি। তাই সাহস করে একসময় এক জোড়া গল্প ভেবে ফেললাম টেলিভিশনের জন্য। স্পার্টাকাস ৭১ এবং এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি আমার সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেছে রেদোয়ান রনি। এর বাইরে কিছু বিজ্ঞাপন করেছি! কিন্তু বিজ্ঞাপন তো বিজ্ঞাপনই!

স্পার্টাকাস ৭১ করতে গিয়ে আমার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিল জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি! বইটা আগেও পড়েছিলাম। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে এই দ্বিতীয় পাঠের সময় বইটা আমার কাছে এক নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হচ্ছিল। এর কারণ হতে পারে, আমার পাঠকমনের বিবর্তন, আগে যে অংশগুলো আমাকে নাড়া দিতে পারছিল না। দ্বিতীয় পাঠের সময় সেই অংশগুলোই আমার সামনে নতুন মানে তৈরি করল, সেই অংশগুলোই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেতাবি সুপারহিরোর নিগড় থেকে মুক্ত করে পুরো বিষয়টাকে অনেক মানবিক করে তুলল আমার কাছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ থেকে সরে যেতে এটা আমাকে অনুপ্রাণিত করল। আমি বেশির ভাগ সময় দেখেছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে এটাকে যান্ত্রিক করে ফেলি। যেমন মুক্তিযুদ্ধ মানেই মা ছেলেকে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছে, প্রাণ যায় যাক, দেশ স্বাধীন না করে ফিরে আসবি না। কিন্তু জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলিতে দেখেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঐকান্তিক কামনা থাকার পরও মা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে সন্তান যেন যুদ্ধে না যায়। কে হায় বুকের ধন হারাতে চায়!

স্পার্টাকাস ৭১ টেলিছবির দৃশ্য
স্পার্টাকাস ৭১ টেলিছবির দৃশ্য

আমাদের যুদ্ধের আলোচনায় কী এক বিচিত্র কারণে ধর্ম বা ধর্মীয় বিশদ পরিচয়গুলোকে হয় প্রায়শই নির্বাসনে পাঠানো হয় অথবা ব্যাকগ্রাউন্ডে ঠেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এই সব তো জীবনেরই সত্য। এই সবকে বাদ দিয়ে খণ্ডিত ইতিহাসই কেবল লেখা সম্ভব হবে, সেই ইতিহাস সবার হয়ে উঠবে না। একাত্তরের দিনগুলিতে যখন আমি পড়ি রুমীর খোঁজে মাজারে শিরনি দিতে যান জাহানারা ইমাম, তখন জাহানারা ইমাম আমার কাছে সন্তান হারানোর আশঙ্কায় থাকা এক বাঙালি মা হয়ে ওঠেন, যার উচ্চতা অলৌকিকতায় অবিশ্বাসী লেখকের চেয়েও বড় আমার কাছে এবং তাঁর এই অকপট বর্ণনা এই পুস্তকটাকে আমার কাছে এই ভূখণ্ডের মানুষের মানচিত্র করে তুলেছে। এই বিষয়টার ছাপও আপনারা স্পার্টাকাস ৭১-এ খুঁজে পাবেন। আপনারা দেখবেন স্পার্টাকাসের মা কী রকমভাবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান সেই দুঃসময়ে।
তবে স্পার্টাকাস ৭১-এর যে দিকটা আমার বুকে এখনো ব্যথার জন্ম দেয়, সেটা হচ্ছে বাবার স্বার্থপরতা ও অপরাধবোধ। নিজের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য বাবা অন্যের সন্তানের জীবন ঝুঁকির মধ্যেও ফেলতে দ্বিধা করেন না সেখানে, জীবনের দাবি এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে সেই সময়ে। কিন্তু যখন বিপদ কেটে যায়, স্বাভাবিক সময় যখন তাঁকে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর ফুরসত দেয়, তখন বাবার অন্তর্গত মানবিকতার বোধ তাঁকে ছোবলে ছোবলে নীল করে দেয়। তিনি নিজেকেই নিজে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই দৃশ্যটার কথা ভাবলে এখনো আমি অসহায় বোধ করি। আমার হাত-পা শীতল হয়ে আসে।
শেষ করব ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’র একটা প্রসঙ্গ দিয়ে। ‘এমন দেশটি’তে খুব স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় আরোহণ এবং বিচারের প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু এটার যে দিকটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে, ঘৃণার চর্চা বংশপরম্পরায় ছড়িয়ে না দেওয়া। একটা সুস্থ শিক্ষিত জাতি যেমন অপরাধীকে বিনা বিচারে ছেড়ে দিতে পারে না, তেমনি পিতার অপরাধে পুত্রকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না। কারণ, এই ঘৃণার পরম্পরা একটা ফাঁদ, একটা অনিঃশেষ কালো গহ্বর। এখানে একবার ঢুকলে আর বেরিয়ে আসার উপায় নেই।