যুদ্ধদিনের মুক্তির গান

নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত গেরিলা ছবির দৃশ্যে জয়া আহসান
নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত গেরিলা ছবির দৃশ্যে জয়া আহসান

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনেক গানই ছিল মুক্তিযুদ্ধের উত্সাহ-উদ্দীপনা আর অনুপ্রেরণার সঙ্গী। তেমনি আলোচিত পাঁচটি গানের প্রেক্ষাপট জানতে চাওয়া হয়েছিল গানগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ২০০৫ সালের ১০ মার্চ সেই গল্প প্রথম আলোয় লিখেছিলেন আশা নাজনীন। বিজয়ের মাসে এ সময়ের পাঠকদের জন্য লেখাটি আবার প্রকাশিত  হলো।

তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে/­আমরা কজন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে।
গীতিকার ও সুরকার: আপেল মাহমুদ
শিল্পী: আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায় এবং সহশিল্পীরা।

পোড়া খয়েরি রঙের স্যুটকেস থেকে নীল রঙের ডায়েরি বের করে এ গানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে শিল্পী আপেল মাহমুদ বলেন, তখন আমাদের কাছে একটা চিহ্নিত শত্রু ছিল। সবাই তাদের বিরুদ্ধে এক ছিলাম। একাত্তরের জুনের শেষ দিকে এ গানটি আমি লিখি। জাতিকে এক করার জন্য, একই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করার জন্য তখন প্রয়োজন ছিল গণসংগীত। আর আমাদের মুক্তির সংগ্রামে ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ গানটি ছিল আন্দোলনের তীব্র চেতনায় এক বজ্রশপথ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমন গান আর লিখতে পারিনি।

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল।
গীতিকার: গোবিন্দ হালদার
সুরকার: সমর দাস
কণ্ঠশিল্পী: সমবেত গান

এ গান সম্পর্কে শিল্পী আব্দুল জব্বার বলেন, যুদ্ধ চলাকালে এ গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বসে রচিত হয় এবং সেখানেই প্রচার হয়। এটি এমন একটি গান ছিল, যার কথা, সুর এবং গায়কি লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত ও উত্সাহী করে তুলেছিল।

এ গান সম্পর্কে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেরা পাঁচ গানের মধ্যে এ গানটি স্থান করে নিয়েছে বলে আমি মনে করি। এই সমবেত সংগীতটি তখন সংগ্রামী সংগীত, যুদ্ধের মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি/মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
গীতিকার: গোবিন্দ হালদার
সুরকার ও শিল্পী: আপেল মাহমুদ

এ গানের সুরকার ও শিল্পী আপেল মাহমুদ বলেন, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ এ গানটি এত গ্রহণযোগ্যতা পাবে, এত জনপ্রিয় হবে, আমি তা বুঝতে পারিনি। গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হওয়ার পর পুরো কলকাতায় এ গানের ব্যানার ছড়িয়ে পড়ে। এখনো মনে আছে, একদিন সন্ধ্যার পর রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ দেখলাম দূরে একটি চায়ের টঙে ৫০–৬০ জন লোকের ভিড়, তারা সমবেত হয়ে গান করছে। কাছে গিয়ে শুনলাম তারা গাইছে—‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’। আমাকে দেখে তারা গান থামিয়ে দিল এবং সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরল। গানটি তাদের সঙ্গে গাইবার জন্য অনুরোধও করল। যুদ্ধ চলাকালে এ গানটি কেবল স্বাধীন বাংলা বেতার নয়, পথে-ঘাটে, রাস্তায় রাস্তায় দলে দলে গেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছি।

জয় বাংলা, বাংলার জয়/হবে হবে
হবে, হবে নিশ্চয়/কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে/নতুন সূর্য ওঠার এই তো সম
গীতিকার: গাজী মাজহারুল আনোয়ার
সুরকার: আনোয়ার পারভেজ
কণ্ঠশিল্পী: সমবেত সংগীত

এ গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, এই গানটি আমি লিখি একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে। গানটির সুর করেন আনোয়ার পারভেজ। আমার কথার তিনি যে সুরের অলংকার পরিয়ে দিয়েছিলেন, তা মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। সাংবাদিকের কাছে তাঁর কলম, কণ্ঠশিল্পীর কাছে তাঁর কণ্ঠ আর গীতিকারের কাছে তাঁর গান ছিল তখন অস্ত্র। আমি মনে করি জয় বাংলা, বাংলার জয় গানটি মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টা মাস মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ গানটি একটি যুদ্ধ, এ গানটি একটি স্বপ্ন, এ গানটি একটি বাস্তবতা। এ গানেই দেশের সব চাওয়ার কথা, মুক্তির স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। এ গানটি পরে জয় বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়।

শোনো একটি মুজিবরের থেকে/
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
গীতিকার: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
সুরকার: অংশুমান রায়
কণ্ঠশিল্পী: অংশুমান রায়

এ গানের শিল্পী আব্দুল জব্বার বলেন, এ গানটি ছিল সেই গান, যেটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই ভারতের কোনো এক বেতার থেকে বাজানো হয়েছিল। কোথা থেকে প্রচার হয়েছে, কে গেয়েছে তার কিছুই তখন জানতাম না, শুধু এই গানটি শুনেছি, তার পরেই আমি যুদ্ধে চলে গিয়েছি। এপ্রিলের দিকে কলকাতায় আমরা যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুলি, তখন এই গানটি আমি গেয়েছি এবং গেয়েছেন আরও অনেকে। তখন জানতে পেরেছিলাম, এটি লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন অংশুমান রায়।