'অতঃপর মাধো' ঘুরে এল দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ায় শারমিন সঞ্জিতা খানম, অলোক বসু ও শামীমা আক্তার
দক্ষিণ কোরিয়ায় শারমিন সঞ্জিতা খানম, অলোক বসু ও শামীমা আক্তার

১৮ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল ডুওপারফর্মিং আর্টস ফেস্টিভ্যাল। ‘কিডপাফ’ নামে সমধিক পরিচিত এই আয়োজনে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন নাটকের দলকে উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবারই প্রথম বাংলাদেশের কোনো একটি নাটকের দল এ উৎসবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পায়। এ উৎসবের বিশেষত্ব হলো উৎসবে প্রদর্শিত নাটকগুলোর অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা হতে হয় মাত্র দুজন। বাংলাদেশ থেকে ‘মেঠোপথ’ থিয়েটার তাদের নাটক অতঃপর মাধো নিয়ে এবারের উৎসবে অংশগ্রহণ করে। ১ ডিসেম্বর সিউলের হাইয়েহওয়া আর্ট স্পেসে নাটকটির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

অতঃপর মাধো নাটকের নাট্যকার ও নির্দেশক হওয়ার কারণে অভিনয়শিল্পী শারমিন সঞ্জিতা খানম ও শামীমা আক্তারের সঙ্গে আমারও দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণের সুযোগ ঘটেছিল। এই নাট্যভ্রমণ আমাদের জন্য ছিল একটি অনন্য অভিজ্ঞতা।

নাটকের বিশ্বভ্রমণ

আমরা যেদিন কোরিয়ায় গিয়ে পৌঁছালাম, সেদিন সন্ধ্যায় উৎসবে প্রদর্শিত হয় আর্জেন্টিনার নাটক মান্দ্রাগরা সার্কাস। এটি অত্যন্ত বিখ্যাত একটি নাটক। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নাটকটি শুরুর সময় হয়ে যায়। যদিও খিদেয় আমাদের পেট চোঁ চোঁ করছে, তথাপি নাটকটি আমরা কোনোমতেই মিস করতে চাইছিলাম না। তাই তাড়াহুড়া করে হোটেলে ব্যাগ রেখে চলে যাই নাটক দেখতে। অসাধারণ প্রযোজনা মান্দ্রাগরা সার্কাস। দুজন অভিনয়শিল্পী পুরো দেড় ঘণ্টা তাঁদের অভিনয়শৈলী দিয়ে দর্শকদের বুঁদ করে রাখলেন।

অতঃপর মাধো নাটকের দৃশ্য
অতঃপর মাধো নাটকের দৃশ্য

ও আমার দেশের মাটি

আমাদের নাটক শুরু হওয়ার আগে দর্শকদের হাতে ইংরেজি ও কোরিয়ান ভাষায় নাটকের কাহিনিসংক্ষেপ তুলে দেওয়া হলো, যাতে তাঁরা আমাদের সংলাপ না বুঝলেও অন্তত নাটকটি যেন বুঝতে পারেন। কোরিয়ার শোর জন্য নাটকে আমরা সামান্য কিছু পরিবর্তন আনলাম। প্রযুক্তিগতভাবে ওরা অনেক দক্ষ। ওদের উঁচু মানের প্রযুক্তি আমাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে ভেবে আমরা আমাদের মতো করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই লাইট ও মিউজিক অপারেট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা জোর দিলাম শারীরিক ও সাত্ত্বিক অভিনয়ের ওপর। শিল্পীরা তাঁদের সংলাপে মাঝেমধ্যে দু–একটি কোরিয়ান শব্দ ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের প্রস্তুতি নিলেন। অতঃপর মাধো নাটক শেষ হয় ‘ও আমার দেশের মাটি’ গান ও কোরিওগ্রাফি দিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো গানটির সঙ্গে কোরিওগ্রাফির একেবারে শেষ সময়ে শিল্পীরা বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার করবেন। যাহোক দুরু দুরু বুকে শুরু করলেও নাটক শেষে দর্শকদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হলো আমরা তাঁদের নিরাশ করিনি। নাটক শেষে ‘মিট দ্য ডিরেক্টর’ ও ‘কর্মশালা’ পর্বে নাটকটি নিয়ে তাঁদের নানা প্রশ্ন ও কৌতূহল দেখে নিশ্চিত হলাম নাটকটি তাঁদের ভালো লেগেছে। পরের দিন সমাপনী অনুষ্ঠানে আমাদের হাতে ‘স্পেশাল পারফরম্যান্স’ বুক অব অনার প্রদান করা হলো।

ধন্য ধন্য বলি তারে

কোরিয়ায় অবস্থানকালে আমাদের সুযোগ হয়েছিল একটি কোরিয়ান দলের ফাইন্ডিং মি. ডেসটিনি নামের একটি নাটক দেখার। নাটকটি ভারতের প্রেক্ষাপটে রচিত। প্রেম, রোমান্স, ড্রামা, নাচ-গান মিলিয়ে একটি জমজমাট এবং উপভোগ্য নাটক। অন্য আরেকটি নাটকের দলের হ্যামলেট কোলাজ নামের নাটকের পূর্ণাঙ্গ মহড়া দেখাতে আমাদের তাদের মহড়াকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হ্যামলেট কোলাজ-এ তারা ওফেলিয়ার পারসপেকটিভ থেকে নাটকটি নির্মাণ করেছে। একটা কথা না বললেই নয়, তিন ঘণ্টা মহড়াকক্ষে বসে থেকে লক্ষ করেছি, কারও মোবাইল ফোন একটিবারের জন্যও বেজে ওঠেনি কিংবা কেউ একবারের জন্যও মোবাইল ফোনটি হাতে নেননি।

যেতে যেতে পথে

সিউল আমাদের দারুণভাবে আচ্ছন্ন করেছে। সবচেয়ে বেশি আচ্ছন্ন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। জানা ছিল যে রবীন্দ্রনাথ একবার সিউলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁর একটা আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। ঠিক কোন জায়গাটায় রয়েছে, তা জানা ছিল না। আমাদেরই যেন দেখা দিতে আমাদের নাটকপাড়ায় যাওয়ার পথে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন পথের মধ্যে। আমরা যে কী আনন্দ পেয়েছি রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে, তা বলার মতো নয়।