পথে পথে তারকারা, চাইছেন ভোট

শাকিব খান, ফেরদৌস, অপু বিশ্বাস, জাহিদ হাসান, তাহসান
শাকিব খান, ফেরদৌস, অপু বিশ্বাস, জাহিদ হাসান, তাহসান

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে, অভিনয়শিল্পীদের শুটিংয়ের ব্যস্ততা যেন ততই কমে আসছে। শুটিংয়ের ব্যস্ততা কমলেও শিল্পীরা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি ব্যস্ত। অভিনয়শিল্পীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সারা দেশে প্রার্থীদের জন্য ভোট চেয়ে জনগণের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। শুটিংবাড়ির চেয়ে তারকারা এখন রাজপথেই বেশি ব্যস্ত। ছুটছেন ঢাকা থেকে দেশের নানা প্রান্তে। কথা বলছেন, ভক্তদের সঙ্গে। ভোট চাইছেন পছন্দের প্রার্থীর জন্য। দেশের সাধারণ মানুষেরা তারকাদের কাছে পেয়ে সেলফি তোলার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছেন না।

চট্টগ্রামে নির্বাচনী প্রচারণায় তারকারা। ছবি–সংগৃহীত
চট্টগ্রামে নির্বাচনী প্রচারণায় তারকারা। ছবি–সংগৃহীত

অভিনয়শিল্পীরা বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেও ১০ ডিসেম্বর থেকে দলগতভাবে বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর জন্য ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। চলচ্চিত্রশিল্পীদের মধ্যে ফেরদৌস, রিয়াজ ও পূর্ণিমাকে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দেখা গেছে। আস্তে আস্তে এ যাত্রায় চলচ্চিত্রের আরও অনেকে শামিল হন।

আজ সোমবার সকালে অভিনয়শিল্পীদের একটা দল কিশোরগঞ্জে যায় নির্বাচনী প্রচারণায়। এই দলে আছেন তানভীন সুইটি, মীর সাব্বির, বিজরী বরকতুল্লাহ, মাজনুন মিজান ও নাদিয়া আহমেদ। সন্ধ্যায় ঢাকায় ফেরার পথে নাদিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত শুটিংয়ের জন্য আগে ঢাকার বাইরে যাওয়া হতো। এখন যাচ্ছি জনগণের সঙ্গে কথা বলতে। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। আমি মনে করি, প্রত্যেক শিল্পীরই একটা দায়বদ্ধতা থাকে। আদর্শিক জায়গা থাকে। সেই জায়গা থেকে আমরা বাংলাদেশের পক্ষের সরকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমান সরকার উন্নয়নের একটা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এই সরকার আবারও দরকার। এই সরকার শিল্পীবান্ধব। দলমত-নির্বিশেষে সব ধরনের শিল্পী ও কলাকুশলীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সব সময় পাশে পেয়েছেন। তাই দেশের স্বার্থে, আমরা শিল্পীদের স্বার্থে এই সরকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল নির্বাচনের আগে দুটি নাটকের কাজ শেষ করার। কিন্তু সারা দেশ এখন নির্বাচনের আমেজে। অভিনয়শিল্পীরাও এখন নির্বাচনী প্রচারণায় বেশি মনোযোগী। শুটিংয়ে থাকলেও তাঁদের আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে নির্বাচন। তাই এই মুহূর্তে শুটিং করার কোনো অর্থ হয় না। সে জন্য শুটিংয়ের সময়টা পিছিয়ে নির্বাচনের পরে রেখেছি।’

চট্টগ্রামে নির্বাচনী প্রচারণায় অভিনয়শিল্পী বিজরীর সেলফিতে তারকারা। ছবি–সংগৃহীত
চট্টগ্রামে নির্বাচনী প্রচারণায় অভিনয়শিল্পী বিজরীর সেলফিতে তারকারা। ছবি–সংগৃহীত

জানা গেছে, দেশে শুটিং একেবারের কমে গেলেও অনেক নির্মাতা নির্বিঘ্নে শুটিং করার জন্য দেশের বাইরের লোকেশন বেছে নিয়েছেন। দেশের বাইরে শুটিংয়ের কারণে তাই অনেক শিল্পী নির্বাচনী আমেজ থেকে দূরে আছেন। কেউ কেউ আবার বলছেন, সশরীরে দূরে থাকলেও ফেসবুকের কারণে মনে হয় না বেশি দূরে আছি।

চিত্রনায়ক ফেরদৌস ও রিয়াজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনেও যোগ দেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেই সফর থেকে ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরও অনেক কর্মকাণ্ডে তাঁদের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা গেছে। ফেরদৌস নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে দেশের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গীও হচ্ছেন। ‘এটা অসাধারণ পাওয়া। নেত্রীর গাড়িবহরের সঙ্গে প্রত্যেকটা জায়গায় যাচ্ছি। সবকিছু খুব কাছ থেকে দেখছি। মনে হচ্ছে, দেশের জন্য কিছু একটা করছি। অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমাদের তরফ থেকে এটা মুক্তিযুদ্ধ। কারণ, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় ভীষণভাবে দরকার। এটা অস্তিত্ব রক্ষার নির্বাচন, সে কারণেই সক্রিয়ভাবে নেমে পড়েছি। মনের ভেতর থেকে উপলব্ধি করে কাজ করছি। আগামী দিনগুলোয় প্রধানমন্ত্রীর যেসব নির্বাচনী প্রচারাভিযান হবে, সব কটিতে আমরা থাকব।’

নির্বাচনী প্রচারণায় তারকারা। ছবি–সংগৃহীত
নির্বাচনী প্রচারণায় তারকারা। ছবি–সংগৃহীত

এর বাইরেও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় রাজপথে সক্রিয় দেখা গেছে জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, মাহফুজ আহমেদ, রোকেয়া প্রাচী, অরুণা বিশ্বাস, শাকিল খান, শাহরিয়ার নাজিম জয়, জ্যোতিকা জ্যোতি, সায়মন সাদিক প্রমুখকে।

সিরাজগঞ্জ-২ (সদর উপজেলার আংশিক ও কামারখন্দ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাংসদ হাবিবে মিল্লাতের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন অভিনয়শিল্পী জাহিদ হাসান। শনিবার বিকেলে এই অভিনয়শিল্পী সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের গুণেরগাঁতী ও স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত উঠান বৈঠকে নৌকা প্রতীকে ভোট চান। বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ করে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জাহিদ হাসান বলেন, ‘বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে।’ তিনি এ আসনের প্রার্থী হাবিবে মিল্লাতকে স্বচ্ছ রাজনৈতিক নেতা আখ্যায়িত করে বলেন, ‘তাঁকে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করলে সিরাজগঞ্জের উন্নয়ন আরও বেগবান হবে।’

নির্বাচনী প্রচারে ২০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাস্তায় দেখা মেলে নাটক ও চলচ্চিত্রজগতের শিল্পীদের। চট্টগ্রামের প্রচারণায় রিয়াজ বলেন, নৌকার সমর্থনে সারা দেশে তাঁরা প্রচার চালাচ্ছেন। দেশব্যাপী নৌকার জোয়ার শুরু হয়েছে। একসময় উন্নয়ন শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই ধারা ধরে রাখতে হবে।

নির্বাচনী প্রচারণায় কিশোরগঞ্জে যাওয়ার পথে সুইটির সেলফিতে তারকারা। ছবি–সংগৃহীত
নির্বাচনী প্রচারণায় কিশোরগঞ্জে যাওয়ার পথে সুইটির সেলফিতে তারকারা। ছবি–সংগৃহীত

অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি বলেন, ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নৌকা প্রতীককে জয়যুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। নৌকাকে বিজয়ী করতে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মীরা এক হয়েছেন। নিরাপদ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য নৌকা প্রতীকে ভোট চাই।’

রাজপথে সক্রিয় হতে না পারলেও ডিজিটাল মাধ্যমে ঠিকই সক্রিয় নাটক, চলচ্চিত্র ও সংগীতাঙ্গনের অনেকে। ফেসবুকে ভিডিওবার্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখার অনুরোধ করেছেন আফজাল হোসেন, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, তাহসান, সিয়ামসহ আরও অনেকে।

ফেরদৌস ও রিয়াজের মতো দেশের নানা প্রান্তে প্রচারণায় অংশ নিতে না পারলেও ভিডিওবার্তা দিয়েছেন অপু বিশ্বাস। ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় তাঁর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেভাবে দেশ উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে; তারই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বিজয়ের এই মাসে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধ ও নৌকার পক্ষে ভোট দেব।’

নির্বাচনী প্রচারণায় তারকারা। ছবি–সংগৃহীত
নির্বাচনী প্রচারণায় তারকারা। ছবি–সংগৃহীত

ভিডিওবার্তায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতি দিয়ে শাকিব বলেন, ‘সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে, তার কোনো পরিমাপ নাই বাইরের দেশটারে; সে অন্তর ময়, অন্তর মেশালি মেলে তার পরিচয়…! এই কবিতার মধ্যে খুঁজে পাই আমাদের মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি। তাঁর আছে নিয়ম, নীতি শৃঙ্খলা। কিন্তু সবকিছুকে পিছনে ফেলে প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে তাঁর মমতার ছায়া। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব মা-বাবাহীন রিতা আর রুনাকে নিজ মেয়ের মর্যাদা দেওয়া থেকে শুরু করে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়া। দেশের অসুস্থ, অসহায় শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিকদের সাহায্য করা! কোথায় নেই তার মমতার ছায়া? একজন পথশিশুকে তিনি যে মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরেন, তা শুধু একজন মা-ই পারেন তাঁর সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। এভাবেই তিনি বাংলাদেশ ও দেশের ১৬ কোটি মানুষকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। আর তাই তো দেশের সাধারণ মানুষ ও পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন “মাদার অব হিউম্যানিটি”। আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে মমতাময়ী শেখ হাসিনাকে নৌকায় ভোট দিন। বুকে হাত রেখে বলুন আমরা বাংলাদেশের পক্ষে।’

আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণায় তারকাদের যেভাবে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে, বিএনপির পক্ষে মোটেও তারকাদের উপস্থিতি চোখে পড়ছে না। জাতীয়তাবাদী আদর্শের শিল্পীরা রাজপথে সক্রিয় না হলেও বিভিন্ন ঘরোয়া আড্ডায় তাঁরা আবার সরব। তারকাদের মধ্যে গায়িকা রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা ধানের শীষের প্রার্থী হয়ে লড়ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপি ও জাসাসের কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মী প্রথম আলোকে আজ সোমবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই বিরোধী মতকে দমন করার জন্য পুলিশের হয়রানি, সরকারি দলের নেতা-কর্মী দ্বারা মারধর করে সারা দেশে আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রচারণা যাতে করতে না পারেন সে জন্য আবার অনেককে ভয়ভীতিও দেখানো হচ্ছে। এতসব অস্থিরতার মধ্যে বাইরে বের হলে অপমানিত হতে হয়, যা একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে অনেক বেশি দুঃখের। সারা জীবন দেশের মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা অর্জন করলেও শুধু ভিন্ন মতাদর্শের কারণে অপমান ও অপদস্থ হওয়াটা খুবই দুঃখজনক বলেও জানান তাঁরা।