নাটক: এই তো সময় আশাবাদী হওয়ার

গ্যালিলিও নাটকে আবার দেখা গেছে আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূরকে। ছবি: প্রথম আলো
গ্যালিলিও নাটকে আবার দেখা গেছে আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূরকে। ছবি: প্রথম আলো

‘কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’। রবীন্দ্রনাথ এই ধরণীকে ভালোবেসেছিলেন, তাই তিনি হিসাব কষতে চাননি। তবে আমরা যারা নাটক নামের ধরণীকে ভালোবাসি, তাদের কিন্তু প্রতিবছরই একটি খতিয়ান মেলাতে হয়। না মেলালে নাটকের সারা বছরের চিত্রটি বোঝা যায় না। একজন দর্শক হিসেবে আমি ২০১৮ সালের একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান প্রদানের চেষ্টা করব, যা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণের সারাংশ, পূর্ণাঙ্গ নয়।

মুক্তিযুদ্ধের ফসল

বলা হয়ে থাকে, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন নাটক। তবে এখন আমাদের নতুন করে ভাবা দরকার, সেই গৌরব কি সত্যি সত্যিই আমরা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছি? না পারার অনেক কারণ রয়েছে। খেলাধুলা কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, নাটকের ক্ষেত্রে তার বিন্দু পরিমাণও নেই। সংস্কৃতি খাতে সরকারের বাজেট নগণ্যাতিনগণ্য। বেসরকারি কিংবা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানে অনাগ্রহী। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আজও আমাদের ন্যাশনাল থিয়েটার ট্রুপ তৈরি হলো না। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল হিসেবে মঞ্চনাটককে প্রত্যাশিত স্থানে দেখতে চাইলে দরকার এর সুষ্ঠু পরিচর্যা, পৃষ্ঠপোষকতা।

উল্লেখযোগ্য নতুন নাটক

নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও মঞ্চে আসা এ বছরের উল্লেখযোগ্য কিছু নতুন নাটক হলো প্রাঙ্গণেমোরের হাছনজানের রাজা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য আলকেমিস্ট, নাগরিকের ওপেন কাপল, হৃদমঞ্চ রেপার্টরির রুধিররঙ্গিনী, আরশিনগরের রহু চণ্ডালের হাড়, যাত্রিক রেপার্টরির অ্যান ইন্সপেক্টর কলস, ঢাকা থিয়েটারের পুত্র, পালাকারের উজানে মৃত্যু। এছাড়া আরও এসেছে মহাকালের শ্রাবণ ট্রাজেডি, বাতিঘরের র​্যাডক্লিফ লাইন, লোকনাট্য দলের (বনানী) ঠিকানা, রাজশাহীর অনুশীলন নাট্যদলের বুদেরামের কূপে পড়া, চট্টগ্রামের নান্দীমুখের আমার আমি, অ্যাভাগার্ডের নবান্ন, সংস্কার নাট্যদলের ভুলস্বর্গ ও মহাপতঙ্গ, অনুরাগ থিয়েটারের গ্রাস, নাট্যমঞ্চ রেপার্টরির ডিয়ার লায়ার, ঢাকা পদাতিকের ট্রায়াল অব সূর্যসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাকবেথ, নাট্যধারার চার্লি, ঢাকা থিয়েটার মঞ্চের বহিপীর, নটনন্দনের নারী ও রাক্ষুসী, বরিশাল শব্দাবলীর বৈশাখিনী প্রভৃতি। এ ছাড়াও রয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকের দুটি নাটক, স্পেস অ্যান্ড অ্যাক্টিং রিসার্চ সেন্টারের দুই আগন্তুক ও করবী ফুল এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাস্থান। উদীচী এবার মঞ্চে এনেছে বিয়াল্লিশের বিপ্লব যাত্রাপালা।

নারীদের অসামান্য অগ্রযাত্রা

সারা যাকের, শিমূল ইউসুফ, নায়লা আজাদ নূপুর, আইরিন পারভীন লোপা এ বছর নতুন নাটক নির্দেশনা দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। লিজা আসমা আক্তার ও আফরিন হুদা তোড়ারও অভিষেক ঘটেছে নির্দেশক হিসেবে। চট্টগ্রামের নান্দীমুখের দীপ্তা রক্ষিত আমার আমি নাটকে একক অভিনয় করে আলোচনায় এসেছেন।

আগ্রহের কেন্দ্রভূমিতে

নাগরিকের গ্যালিলিও, দেশনাটকের নিত্যপুরাণ, আরণ্যকের ইবলিশ নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন ঘিরে লক্ষ করা গেছে দর্শকের প্রবল আগ্রহ। এ ছাড়া কিঞ্চিৎ পুরোনো হলেও বটতলার ক্রাচের কর্নেল, শূন্যণের লালজমিন, মেঠোপথ থিয়েটারের অতঃপর মাধো, ম্যাড থিয়েটারের নদ্দিউ নতিম, থিয়েটারওয়ালার জবর আজব ভালোবাসা প্রভৃতি নাটকের প্রতিও ছিল দর্শকের সমান আগ্রহ।

ব্যতিক্রমী আয়োজন

নাট্যজন আলী যাকের, মামুনুর রশীদ ও নাসিরউদ্দীন ইউসুফকে নিয়ে ছিল দুটি ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন। নতুন সংগঠন থিয়েটার ফ্যাক্টরি গত ৯ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে ‘আলী যাকেরের সঙ্গে কিছুক্ষণ’ শিরোনামে এক আলাপচারিতার আয়োজন করে। ৫ অক্টোবর নাট্যজন মামুনুর রশীদ ও নাসিরউদ্দীন ইউসুফকে নিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে একই ধরনের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এ বছরেই জন্ম নেওয়া সংগঠন থিয়েটার ডিরেক্টরস ইউনিটি।

বিদেশে আমাদের নাটক

আমাদের নাটক দেশের বাইরেও সমাদৃত হচ্ছে সমানভাবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় মেঠোপথ থিয়েটারের অতঃপর মাধো, জাপানে স্বপ্নদলের ত্রিংশ শতাব্দী, যুক্তরাজ্যে নাগরিক এবং নটনন্দনের যথাক্রমে ওপেন কাপল এবং নারী ও রাক্ষুসীর প্রদর্শনী প্রশংসিত হয়।

আলোচনা–সমালোচনায় আরও কিছু

আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ৫০ বছর ও দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর ৪৫ বছর পূর্তি পালন। অনুশীলনের ৪০ বছর পূর্তি। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সম্মেলন, নতুন কমিটি নির্বাচন, ফলাফল গণনা ও ঘোষণা নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা প্রশ্ন—যা নাটকসংশ্লিষ্ট সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলে। বছরজুড়ে নাটকের নানা রকম উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও এসব উৎসব ব্যাপক সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়। আইডিএলসির অর্থায়নে আয়োজিত নাট্যোৎসব ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে নাটকের দর্শনী মূল্য না থাকার কারণে। আর গঙ্গা-যমুনা উৎসবের আয়োজন-পরিধি বড় হলেও এ উৎসব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে নাটক নির্বাচনে বৈচিত্র্য না থাকা এবং মানসম্মত নাটকের অভাবে।

সব মিলিয়ে আমরা নিরাশ না হলেও প্রবলভাবে আশাবাদী হতে হলে প্রয়োজন অনতিবিলম্বে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব মহলের আন্তরিক সহযোগিতা।

লেখক: নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা