শতবর্ষে - নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী

বুলবুল চৌধুরী
বুলবুল চৌধুরী

নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার জন্য অন্যতম কথাশিল্পী সাহিত্যিক আবুল ফজলের একটি উক্তির উল্লেখ করছি, ‘একক বুলবুলই এ দেশের নৃত্যশিল্পকে বিশ্বের নৃত্যশিল্পের মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছেন, আর নিজেও একক সাধনার দ্বারা পৌঁছেছিলেন নৃত্যশিল্পের উচ্চতর মানে।’

বুলবুল নৃত্যে স্বশিক্ষিত ছিলেন, তাঁর সৃজনশীলতা অত্যন্ত প্রগাঢ় ও তীক্ষ্ণ ছিল। তিনি স্কুলে পড়াকালীন ‘চাতকনৃত্য’টি সৃজন করেন ও অনেক অনুরোধের ফলে একটি বিচিত্রানুষ্ঠানে নৃত্যটি পরিবেশন করার অনুমতি পান। নৃত্যটি উপস্থিত দর্শকদের মোহিত করে।

পরবর্তীকালে বুলবুলের অসাধারণ কালজয়ী নৃত্যনির্মিতির স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পত্রপত্রিকায় ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়, ‘উদয় শঙ্করের পরবর্তীকালীন যাঁরা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যে বুলবুল চৌধুরী অন্যতম। তাঁর নৃত্যে আবেগ আছে, দর্শকের হৃদয়কে আবেগাপ্লুত করে তোলার কৌশলও তাঁর আয়ত্তে আছে।’

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বুলবুল মনেপ্রাণে একজন সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পের জন্য শিল্পী নয়—মানুষের জন্য শিল্পী। জীবনের জন্য শিল্প। দেশ ও জাতির জন্য শিল্প। শুধু শৈল্পিক পারদর্শিতা কারিগরি সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ থাকা অর্থহীন। মানবসভ্যতার উত্তরণে শিল্পীকে যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে শিল্পের হাতিয়ার নিয়ে। শিল্পীকে সজাগ থাকতে হবে দেশকাল, সর্বোপরি মানবজাতির কল্যাণ সম্পর্কে। আর তাই শিল্পচর্চার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের পাঠও নিতে হবে।

বুলবুলকে ‘জিহাদি শিল্পী’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত সমাজ সচেতন মানবহিতৈষী ব্যক্তি ছিলেন। এক অন্ধকারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারযুক্ত সময়ে এই মহান শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এসব প্রতিকূলতাকে তাঁর অদম্য সাহস, ধী–শক্তি, ধৈর্য ও সহনশীলতা দিয়ে অতিক্রম করতে সক্ষম হন। কথিত আছে, বুলবুল একবার একটি অনুষ্ঠানে তাঁর দল নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করতে যান (সম্ভবত চট্টগ্রামে), কিন্তু সেখানকার মৌলবাদীরা তাঁকে বিরত রাখার জন্য নানাভাবে বাধা দেয়। একসময় তারা বুলবুলের যাতায়াত পথে শুয়ে পড়ে ব্যারিকেড তৈরি করে। আপসহীন স্বাধীনচেতা বুলবুলকে ঠেকায় কার সাধ্য, বুলবুল সেই শায়িত বিরোধী মৌলবাদীদের পাশ কাটিয়ে সন্তর্পণে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে গেলেন। সেখানে তিনি বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেন এবং যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে বাক্​যুদ্ধে তাদের পরাস্ত করে একটি সফল নৃত্যানুষ্ঠান উপহার দেন উপস্থিত দর্শকদের।

অকুতোভয় বুলবুল দৃঢ় মনোবল নিয়ে জীবনের যেকোনো পর্যায়ে সদর্পে এগিয়ে গেছেন। তীব্র আর্থিক অনটন, অসহযোগিতা, বাধাবিপত্তি—কোনো কিছুর কাছেই নতিস্বীকার করেননি। তিনি জীবন বাজি রেখে শেষদিন পর্যন্ত নৃত্যশিল্পের উন্নয়ন, প্রচার ও প্রসারের জন্য বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল অধিষ্ঠানের জন্য অক্লান্ত চিন্তা ও চেষ্টা করে গেছেন।

বুলবুল একাধারে চিত্রশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যশিল্পী ছিলেন। তিনি অজয়কুমার ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রাচীতে আমরা সাহিত্যিক বুলবুলকে পাই। নাগরিক ও পাদপ্রদীপ নামে তাঁর আরও দুটি উপন্যাস রয়েছে। অভিনয়শিল্পী বুলবুল নায়ক ও পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন ইবসেনের ছায়া অবলম্বনে রচিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম নাটক চোরাবালিতে। এ ছাড়া নাট্যচক্র প্রযোজিত নীলদর্পণ নাটকেও তিনি অভিনয় করেন। তাঁর সহশিল্পী ছিলেন শোভা সেন, মৃণাল সেন, তাপস সেন, ঋত্বিক কুমার ঘটক প্রমুখ শিল্পী। ১৯৪১ সালের দিকে বুলবুল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঝড়ের দোলায় নামক নাটিকার বেতার রূপ দেন—এ থেকেই বুলবুল যে কতটা প্রতিভাধর ছিলেন তার পরিচয় মেলে।

এই অনন্য বহুমুখী প্রতিভাবান শিল্পী বিশ্বাস করতেন জ্ঞানের আলো পূর্ণতার পথে এগোতে সাহায্য করে। তাই তিনি প্রায়ই শিল্প-সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনাসভার আয়োজন করতেন। যার ফলে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার হতো, অন্তর হতো আলোকিত।

নৃত্যপাগল, নৃত্যঅন্তঃপ্রাণ বুলবুলের জন্য তাঁর সহধর্মিণী আফরোজা বুলবুলের (প্রতিভা মোদক) লেখা থেকে তুলে ধরছি, ‘বাঙালি সমাজের বিশেষ করে মুসলিম বাঙলার ইজ্জত চারুশিল্পের মাধ্যমে দেশে–বিদেশে তুলে ধরার ব্রত তিনি নিয়েছেন। কপর্দহীন হয়েও যে অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা, কিভাবে নিজের আরাম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে কি আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস ও সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।’

বুলবুল চৌধুরীর আসল নাম ছিল রশীদ আহম্মেদ চৌধুরী। ডাকনাম টুনু। বুলবুল চৌধুরী তাঁর পোশাকি নাম। আর্থিক সচ্ছলতায় বেড়ে ওঠা বুলবুল পরবর্তীকালে বেশ আর্থিক অসচ্ছলতায় ছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রাপ্ত প্রশংসার ঝুলি ছিল পরিপূর্ণ। মাথার মুকুটে যোগ হতে থাকে একের পর এক বিজয় পালক।

দেশে–বিদেশে নৃত্য পরিবেশন করে যে ভূয়সী প্রশংসা তিনি ও তাঁর দল দেশের জন্য বয়ে নিয়ে আসেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি। ১৯৫৩ সালের ২৭ এপ্রিল বুলবুল চৌধুরীর জীবনের অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে প্রথম তিনি ও তাঁর শিল্পীরা ‘ইউরোপিয়ান প্রিমিয়ার’ নামে ইউরোপের রঙ্গমঞ্চেও নৃত্য পরিবেশন করেন। পরদিন প্রধান পত্রিকাগুলো ভূয়সী প্রশংসা করে, যার মধ্যে ছিল ইভিনিং মেইল, লেইসেস্টার ক্রনিকল, ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটসম্যান, ডেইলি টেলিগ্রাম, ডেইলি ওয়ারিওর, দ্য আইরিশ টাইম ইত্যাদি।

জীবনের এই স্বল্পপরিসরে বুলবুল কত কাজ, কত অসাধ্যই না সাধন করেছেন। তিনি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৭ মে ১৯৫৪ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।

নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীর শততম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।

লেখক : সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব