ভীষণ বিরক্ত অনুপম

অনুপম রায়
অনুপম রায়

কলকাতা এখন ছোট্ট একটা বাংলাদেশ। কারণ, ঢাকার শিল্পীদের অনেকে এখন এখানে। গান করতে এখানে তাঁরা নিয়মিতই আসেন। তবে এবারের আসা আশা–জাগানিয়া। দুই বাংলার শিল্পীদের নিয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে বাংলা উৎসব। আর এটা যদি নিয়মিত করা যায়, বাঙালি ও বাংলা গানের জন্য সেটা হবে এক দারুণ ব্যাপার। তবে উৎসবের প্রথম দিনের ব্যবস্থাপনায় শিল্পীরা তেমন খুশি হতে পারেননি। সব শেষ পরিবেশনায় চলচ্চিত্রের গান করতে এসে নিজের বিরক্তির কথা প্রকাশ করেছেন কলকাতার শিল্পী অনুপম রায়।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে কলকাতা রবীন্দ্রসরোবরের নজরুল মঞ্চ মিলনায়তনে টিকিট কেটে গান শুনতে এসেছিলেন হাজার খানেক দর্শক। তাঁদের মধ্যে মাঝবয়সী ও প্রৌঢ়ের সংখ্যাই বেশি। দুই বাংলার আয়োজনে সেখানে শুরু হয়েছে তিন দিনের বাংলা উৎসব। বাংলাদেশের গান সম্পর্কে স্মৃতিকাতরতা ছিল বলেই এসেছিলেন পল্লব ভট্টাচার্য নামের এক প্রৌঢ়। মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে চলে আসেন কলকাতায়। আর ফেরেননি। তিনি জানালেন, ‘সব কটা জানালা’ গানটিতে যেন তাঁকেই ফিরে যেতে বলা হয়েছে নিজের দেশে। গতকাল সন্ধ্যার পরই এ উৎসবে আজীবন সম্মাননা জানানো হয় বাংলাদেশের শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনকে। মঞ্চে খালি গলায় তিনি গেয়ে শোনান ওই গানটি। একই সঙ্গে আজীবন সম্মাননা জানানো হয় ভারতের শিল্পী আরতী মুখোপাধ্যায়কে।

এ সময়ের দুই বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী অনুপম রায়। তিনি মঞ্চে উঠতে উঠতে দর্শকসংখ্যা কমে যায়। বাকিদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি গেয়ে শোনান ‘বোবা টানেল’, ‘বাড়িয়ে দাও তোমার হাত’, ‘গভীরে যাও’, ‘যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে’ গানগুলো। মঞ্চ থেকে ফেরার পর এ উৎসব নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উৎসব করলে ঠিকমতো প্রস্তুতি নিয়ে করতে হবে। কোনো প্রচারণা নেই কিছু নেই, লোকে জানবে কীভাবে যে এখানে কিছু একটা হচ্ছে!’ তিনি আরও বলেন, ‘ডিসিপ্লিন না থাকলে এত বড় করে কিছু করা যাবে না, ছোট করে করতে পারত। যেখানে অনেক বড় শিল্পী থাকেন, সেখানে সময়ানুবর্তিতাটাই মূল কথা। ১০টার সময় সাউন্ড চেক মানে ১০টাতেই করা উচিত। তখন যদি কেউ বসে বসে তার গোঁজে, তখন কিন্তু কাজ করা মুশকিল।’

উৎসবের আয়োজন করতে গিয়ে গায়ে খাটতে হচ্ছে তারকা আয়োজকদের। নিজেই দৌড়ঝাঁপ করছিলেন কলকাতার অভিনেতা ও প্রযোজক অরিন্দম শীল। কোথায় চেয়ার বসবে আর কোথায় খাবার দিতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত বাতলে দিচ্ছিলেন তিনি। বিশিষ্টজনদের খাবারের স্টলটির নাম ইংরেজিতে কেন হবে? বাংলাদেশের লুভা নাহিদ চৌধুরীকে বলেন, ‘নামটা বাংলায় হলেই ভালো হয় না? বৈঠকখানা হলে কেমন হয়?’ নিজে কাজ করতে ভালোবাসেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। স্থানীয় আয়োজকদের ওপর খুব একটা সন্তুষ্ট মনে হলো না তাঁকে। মাছ ধরার জাল দিয়ে মঞ্চ সাজানোর ধারণাটি পছন্দ হয়নি তাঁর। এ জন্যই শিল্পীদের উপহার দেওয়ার উৎসব স্মারকও বাংলাদেশ থেকে বানিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁরা। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলো ও শব্দ ব্যবস্থাপনা হতাশ করেছে শিল্পী ও আয়োজকদের। সবচেয়ে বড় অনুযোগ ছিল সময়ানুবর্তিতার। নির্ধারিত সময়ে কোনো ক্রমেই শুরু করা যায়নি উৎসব।

সন্ধ্যার পরপরই অপেক্ষা কক্ষে বসে থাকতে দেখা যায় শিল্পী নচিকেতাকে। সেলফি শিকারিদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে একসময় মঞ্চে ওঠেন তিনি। ঝটপট একের পর এক গেয়ে শোনান ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন’, ‘নীলাঞ্জনা’, ‘অনির্বাণ’, ‘ফেসবুক’ গানগুলো। গান শেষে একটুও দেরি করেননি। মঞ্চ থেকে নামার পর গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর পিছু নেন অন্তত ৩০ জন তরুণ। ফাহমিদা নবী গেয়ে শোনান ‘লুকোচুরি গল্প’, বাবা প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী প্রয়াত মাহমুদুন্নবীর ‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ’সহ আরও কিছু গান। তাঁর গানের সঙ্গে গিটার বাজান বাপ্পা মজুমদার। তিনি গেয়ে শোনান ‘বৃষ্টি পড়ে’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘তুমি আমার বায়ান্ন তাস’ গানগুলো। রবীন্দ্রসংগীতের পালায় শুরুর দিকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা শোনান ‘দয়া দিয়ে হবে গো মোর’, ‘কার মিলন চাও বিরহী’, ‘ও নিঠুর, আরও কি বাণ তোমার তূণে আছে’ গানগুলো। রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি ঋতুর গান করেন কলকাতার শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র এবং গান করেন প্রবুদ্ধ রাহা।

বিকেলে ‘বাংলা উৎসব ২০১৯’ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, বন্ধন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চন্দ্রশেখর ঘোষ, বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট ইন্দ্রজিৎ সেন, নাথিং বিয়ন্ড সিনেমার ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরিন্দম শীল, পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার প্রমুখ।

তিন দিনের বাংলা উৎসবের দ্বিতীয় দিন আজ শনিবার। আজ মঞ্চের শব্দযন্ত্র জাগবে বেলা ১২টায়। যথারীতি দুই বাংলার শিল্পীরা গাইবেন তাঁদের সেরা গানগুলো। রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত লোকসংগীত পরিবেশন করবেন করবেন গৌতম দাস বাউল, রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করবেন দুই দেশের দুই শিল্পী—বুলবুল ইসলাম, লাইসা আহমদ, অদিতি মহসিন ও জয়তী চক্রবর্তী। পুরোনো দিনের বাংলা গান গাইবেন ইফ্ফাত আরা দেওয়ান। নজরুলগীতি পরিবেশন করবেন খায়রুল আনাম শাকিল ও ইন্দ্রানী সেন। চন্দনা মজুমদারের লোকসংগীতের সঙ্গে শ্রোতার অন্তরে ভালো লাগার অনুভব ছড়াবে বাংলাদেশের ব্যান্ড চিরকুট। নতুন প্রতিভা হিসেবে আজ গান করবেন কলকাতার শিল্পী আকাশ ভট্টাচার্য ও অঙ্কিতা বসু এবং ঢাকার মোস্তাফিজুর রহমান ও ডলি মণ্ডল।

উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে আনা হয়েছে পাতুরি ও বাংলার মিষ্টি। কলকাতাবাসীকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মিষ্টির অভিজ্ঞতা দিতে এ ব্যবস্থা করেছে বেঙ্গল এক্সপ্রেস।