'অনুদ্ধারণীয়'র আঁতুড়ঘরে...

>বছরের শুরুতে দর্শকের জন্য নতুন নাটক উপহার দিচ্ছে থিয়েটার আর্ট ইউনিট। কাল জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে দেখা যাবে দলের ৩২তম প্রযোজনা অনুদ্ধারণীয়র প্রথম প্রদর্শনী। এরপর ২০ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে ‘হাজার দুয়ারী নাট্যোৎসব’-এ নাটকটির দ্বিতীয় প্রদর্শনী হবে। গেল রোববার শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকটি মহড়া দেখতে গিয়েছিলেন মাসুম আলী।
অনুদ্ধারণীয়র মহড়ায় ব্যস্ত থিয়েটার আর্ট ইউনিনের শিল্পীরা
অনুদ্ধারণীয়র মহড়ায় ব্যস্ত থিয়েটার আর্ট ইউনিনের শিল্পীরা

নিজের লোভের চাপটা এড়িয়ে গেলেন!
কবির মননে আক্রমণ করছেন অমিত। ঠিক অমিত নয়, অমিতেরা। বেশ কয়েকজন অমিতকে দেখা গেল জাতীয় নাট্যশালার সুপরিসর মহড়াকক্ষটিতে। মাঝে একজন বিখ্যাত কবি, সরকারের একটি কমিশনের চেয়ারম্যান ও একজন ভিআইপি—দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী। নাম নাসিরউল্যাহ মজুমদার; কবি নাসির মজুমদার। তাঁকে নানা অভিযোগে আক্রান্ত করে অমিতেরা। যেখানে স্পষ্ট হয় তারুণ্যের সঙ্গে প্রৌঢ়ত্বের দ্বন্দ্ব।

 আমরা তখন থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নতুন নাটক অনুদ্ধারণীয়র আঁতুড়ঘরে। রোববার সন্ধ্যায় এখানে ছিল নাটকটির শেষ মহড়া। তাই শেষ পর্যন্ত কীভাবে সুচারু করা যায় নাটকটি, তারই চেষ্টা করছেন দলের সদস্যরা। মঞ্চে যা দেখা যাবে, শোনা যাবে তার অনুশীলনের পাশাপাশি শব্দ, আলোসহ মঞ্চে ব্যবহারের অনুষঙ্গ (প্রপস) তৈরির কাজও হচ্ছে এই আঁতুড়ঘরে।

থিয়েটার আর্ট ইউনিটের এই নতুন নাটক অনুদ্ধারণীয় করা হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর ছোটগল্প অবলম্বনে। নাটকটির নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিচ্ছেন মোহাম্মদ বারী। কাল ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। রোববার শিল্পকলা একাডেমিতে মহড়া শেষ করে পরের সোম ও মঙ্গলবার দুই দিন মহিলা সমিতির মঞ্চে নাটকটির কারিগরি মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।

বিচ্ছিন্ন অংশ অনুশীলন করেন অভিনয়শিল্পীরা। পুরো নাটক (রান থ্রু) দেখার সুযোগ হয়নি। আপাতত দেখে যা বোঝা গেল, পার্বত্য এলাকায় জঙ্গলে ঘেরা একটি গোপন আস্তানায় একজন প্রৌঢ়কে ধরে নিয়ে এসেছে কয়েকজন তরুণ। ঘরটি অপরিচ্ছন্ন ও বিশৃঙ্খল। ঘরে রয়েছে একটি সাধারণ টেবিল, ওপরে চায়ের সরঞ্জাম। প্রৌঢ়ের শরীরী ভাষায় আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

কবি এবং অমিতের কথোপকথন চলতে থাকে। একসময় অমিত চলে গেলে কবি কথা বলতে থাকেন তাঁরই ছায়ার সঙ্গে। কবির স্মৃতিচারণা করে তাঁর উত্তাল যৌবনের সময়কাল, যখন তিনি কবিতার চাষাবাদ করতেন। দিন–রাত গিলেছেন কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, বোদলেয়ার, রিলকে, শেলি, আইনস্টাইন, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ...। উঠে আসে কবির সেই কিশোরবেলায় বর্ষার এক অন্ধকার রাতের কথা। যে রাতে আকাশ ভেঙে এসেছিল বৃষ্টি। কথোপকথনের একপর্যায়ে কবি চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘সর্বত্র মুনাফার রাজত্ব। কোথায় দেশপ্রেম, কোথায় নীতিবোধ, কোথায় বিবেক, আমার বিদ্রোহী মন চিৎকার করে বলেছিল মুক্তি চাই। পাশে কেউ নেই, আমি একা। আমি একাই ডাক দিয়েছিলাম—বল বীর, বল উন্নত মম শির...।’ এ সময় নেপথ্যে থেকে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার কোরাস উচ্চারিত হতে থাকে। কালো পোশাকের পাঁচ তরুণের প্রবেশ করে কোরিওগ্রাফি শেষে কবিকে ঘিরে দাঁড়ায়। এখানে এসে অভিনেতা মোহাম্মদ বারী আবার নির্দেশক হয়ে ওঠেন, ‘আপাতত এখানেই থাক। চা, শিঙাড়া খাই চলো।’

মহড়ায় খণ্ড খণ্ড দৃশ্য দেখে মূল গল্পটা ধরা যায় না। যদিও বুদ্ধদেব বসুর গল্প অনুদ্ধারণীয় পড়া ছিল। কিন্তু নাটকে নতুন কিছু শব্দ উপস্থিত। যেমন একপর্যায়ে যখন কবি বলেন, ‘আমি সারা জীবন মানুষের কথা ভেবেছি, মানুষের জন্য করেছি, দেশকে ভালোবেসেছি। তখন এক এক করে উঠে আসে ধারা-৫৭, কোটা আন্দোলন, হাতুড়িপেটা, পেট্রলবোমা, আগুন–সন্ত্রাস, হিন্দু বাড়ি উচ্ছেদ, নদী দখল, ব্যাংক লুট, হেলমেট বাহিনীর মতো স্থানীয় প্রসঙ্গের পাশাপাশি আরও উঠে আসে সিরিয়া বা ফিলিস্তিনে রক্তাক্ত শিশুর মুখ, মিয়ানমারের সীমান্তে সৈনিকের গুলিতে উড়ে যায় রোহিঙ্গাদের মাথার খুলি, দাউ দাউ করে পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ির চিত্র। একফাঁকে নির্দেশক এবং নাট্যকার মোহাম্মদ বারীর সঙ্গে কথা বলি। জানতে চেষ্টা করি নাটকের সারমর্ম। জানতে পারি ‘অনুদ্ধারণীয়’ মূলত প্রতিষ্ঠানবিরোধী তারুণ্যের রোমান্টিসিজমের গল্প; দুটি চরিত্র-কবি ও কবিভক্ত অমিতের চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় নাটকের কাহিনি।

মহড়া চলাকালে সিঁড়ি বেয়ে ফেরার পথে প্রথমে শোনা কিছু সংলাপ মাথায় ঘুরপাক খায়, ‘ক্ষমতার লোভ আপনাকে পেয়ে বসেছে। ওপরে ওঠার যে সিঁড়িটাকে চিরকাল ঘৃণা করেছেন, সেই সিঁড়িই হয়ে উঠল আপনার আরাধ্য। যে বিশ্বাস আপনি বুকে ধারণ করতেন, সেটা হয়ে উঠল আপনার মুখোশ...’।

কবিতার মতো লাগে সংলাপগুলো। মঞ্চে পূর্ণাঙ্গ অনুদ্ধারণীয় দেখার ইচ্ছাটা প্রবল হয় ।