২০১৮-এর ব্যবসাসফল ছবি

দেবী ছবিতে জয়া
দেবী ছবিতে জয়া

বাংলাদেশের সিনেমা ৪৪টি, আর আমদানি করা বাংলা সিনেমা আরও ১২। এই ছিল গত বছরের চলচ্চিত্র–ব্যবসার পসরা। কিন্তু পসরার সংখ্যা যতই হোক না কেন, দেশের বেশির ভাগ সিনেমার ক্ষেত্রেই বক্স অফিস ছিল অন্ধকার। হাতে গোনা কয়েকটি সিনেমা ব্যবসায়িক সাফল্যের শিকে ছিঁড়েছে। পুরোনো বছর শেষ হতেই শুরু হয়েছে লাভক্ষতির হিসাব মেলানোর পালা। কার মুখে কতটা হাসি ফুটল? কোন সিনেমা আয় করল কত? আর কপালই–বা পুড়ল কার?

মন্দ–ভালোর সিনেবাজার
ফেলে আসা বছর শুরু হয়েছিল পুত্র ছবিটি দিয়ে। শেষ ছবি ছিল অর্পিতা। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি ও চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে দেশি–বিদেশি মিলিয়ে মোট ছবি চলেছে ১১৬টি। এর মধ্যে কিছু চলচ্চিত্র দর্শকের মন ছুঁয়েছে, কিন্তু ব্যবসা করেছে লবডঙ্কা। বেশির ভাগ ছবির প্রযোজক নাকি লগ্নির টাকাই ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।

মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে ঘুরেফিরে মাত্রাভেদে আলোচনায় এসেছে দেবী, পোড়ামন ২, স্বপ্নজাল, ভাইজান এলো রে, চালবাজ, ক্যাপ্টেন খান, জান্নাত, আমি নেতা হবো আর চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া।শুটিং শুরুর আগে কিছু কিছু ছবি নিয়ে আওয়াজ উঠেছে প্রচুর। কিন্তু মুক্তির পর হতাশায় সে আওয়াজ ম্লান হয়ে গেছে। আবার কিছু কিছু ছবি ছাপিয়ে গেছে প্রত্যাশার সীমানা।

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, প্রেক্ষাগৃহ কৃর্তপক্ষ, বুকিং এজেন্ট সমিতি ও চলচ্চিত্র প্রযোজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর সব মিলিয়ে পাঁচটি সিনেমা দর্শকপ্রিয়তার পাশাপাশি পেয়েছে ব্যবসায়িক সফলতা।

শীর্ষে ‘দেবী’
২০১৮ সালে সবচেয়ে বড় চমকটি দেখিয়েছেন জয়া আহসান। দেবী চলচ্চিত্রটি দিয়ে তাঁর প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সি–তে সিনেমার এই ছবি এবার বাজিমাত করেছে। সরস্বতী–লক্ষ্মীর যুগলবন্দী ঘটেছে ছবিটিতে। রুচিশীল দর্শক যেমন তৃপ্তি দিয়েছে, ব্যবসাও করেছে দারুণ। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সাফল্যের এক নতুন নজির গড়েছে ছবিটি। মধ্যপ্রাচ্যের আরও চারটি দেশে মুক্তি পাবে অচিরেই। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অঙ্গনের কর্তাব্যক্তিরা প্রথম আলোকেজানান, অনম বিশ্বাস পরিচালিত দেবী সিনেমাটি দর্শকনন্দিত হয়েছে, আবার চুটিয়ে ব্যবসা করে উঠে এসেছে শীর্ষে।

সফল ‘পোড়ামন ২’
দেশের অন্যতম ব্যস্ত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া থেকে মুক্তি পেয়েছিল বেশ কিছু ছবি। তার মধ্যে জুন মাসে মুক্তি পাওয়া পোড়ামন ২ ছবিটি ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ছবিতে দর্শকেরা পেয়েছে নতুন এক জুটি—সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরি। তাঁদের অভিনয় ও রসায়ন দর্শক লুফে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আবদুল আজিজ জানান, ‘দেশে পোড়ামন ২ ছবির কালেকশন ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ছবিটি ভারতে মুক্তি পাবে, সেখানেও ব্যবসা হবে। ডিজিটাল স্বত্ব আছে ৪০ লাখ, ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের স্বত্ব ২৫ লাখ। আশা করছি সব মিলিয়ে ব্যবসা হবে ৩ কোটির মতো। আমাদের আর দুটি ব্যবসাসফল সিনেমা সুলতান দহন।’

দেশের বাইরে বাংলা ছবি
বাংলাদেশের সিনেমা এখন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রবাসী বাঙালিদের এসব বড় বাজারের দেশে ছবি প্রদর্শনের উদ্যোগ নেয় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো ও বঙ্গজ ফিল্মসের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর গত মঙ্গলবার স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সৈকত সালাউদ্দিন জানান, ‘গেল বছর আমরা দেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশি ছবি হিসেবে গহীন বালুচর মুক্তি দিই। এরপর স্বপ্নজাল।লম্বা বিরতির পর দেবী। আমাদের অভিজ্ঞতায় অতীতের সব ব্যবসায়িক রেকর্ড দেবী ভেঙে ফেলেছে।’

একই কথা বললেন বঙ্গজ ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তানিম মান্নান। তিনি জানান, গত বছর তাদের প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে নয়টি ছবি মুক্তি দিয়েছে। বাংলাদেশের হালদা, দেবী, পোড়ামন ২ এবং ভারতের ময়ূরাক্ষী, ঊমা, এক যে ছিল রাজা, গুপ্তধনের সন্ধানে, আবার ব্যোমকেশ এবং আহারে মন। তিনি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা ছবির প্রদর্শনের ব্যবসায় আমরা দুই বছর ধরে জড়িত। বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে এযাবৎ ১৭টি সিনেমা মুক্তি দিয়েছি। এই দুই বছরে ব্যবসায় দেবী ইতিহাস গড়েছে। শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকেই বাংলাদেশি টাকায় এর বক্স অফিস সংগ্রহ ছিল ১ কোটি টাকা।’

ব্যবসায় নয় প্রশংসায় এগিয়ে ‘স্বপ্নজাল’
দীর্ঘ বিরতির পর গেল বছর স্বপ্নজাল নিয়ে আসেন পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম। এতে অভিনয় করেন পরীমনি ও নবাগত ইয়াশ রোহান। বাণিজ্যিক ছবির পরীমনি এ ছবিতে আসেন নতুন এক রূপে। পরিচ্ছন্ন এ ছবিটির জন্য গিয়াসউদ্দিন সেলিম রুচিশীল দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছেন। প্রশংসিত হয়েছে পরীমনির নতুন রূপ ও অভিনয়ও। পরীর বিপরীতে নতুন ইয়াশ রোহানও মানিয়ে গেছেন। দর্শক মুগ্ধ হয়েছে ফজলুর রহমান বাবু ও ইরেশ যাকেরের অভিনয়ে। ছবিটি ভালো ব্যবসা করতে পারেনি বলে আফসোস ছিল অনেকের। তারপরও স্বপ্নজালকেগত বছরের অন্যতম সেরা ছবির তালিকায় রেখেছেন বোদ্ধারা।

 সবার দৃষ্টিতে যে ছবিটি এত সফল, সেই দেবী ছবিটির প্রযোজক ও অভিনয়শিল্পী জয়ার কী ভাবনা? কলকাতা থেকে জয়া বললেন, ‘ছবিটা আমি সততার সঙ্গে বানিয়েছি। দর্শক এ ছবি দেখবে, তা ভেবেছিলাম। তবে সিঙ্গেল স্ক্রিনে এতটা সাড়া ফেলবে, ভাবিনি। ময়মনসিংহের ছায়াবাণী বা চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন সিনেমা হলে দর্শকদের যে আগ্রহ আমি দেখেছি, তার চেয়ে বড় পাওনা তো আর কিছু নেই।’

বিশেষজ্ঞ মত
মুশফিকুর রহমান গুলজার
সভাপতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্য, সেন্সরবোর্ড
আমার দৃষ্টিতে ২০১৮ সালের আলোচিত সিনেমা স্বপ্নজাল, দেবী, পোড়ামন ২ ও ভাইজান এলো রে। এসবের মধ্যে দেবীর বাজেট ছিল অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু এটিই দর্শক দেখেছে সবচেয়ে বেশি। সে হিসাবে ব্যবসা ও দর্শকপ্রিয়তায় জয়ার দেবী ছবিটিই এগিয়ে। যাঁরা দীর্ঘদিন প্রেক্ষাগৃহে আসেননি, তাঁরাও ছবিটি দেখতে হলে ভিড় করেছেন। কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ, জয়া আহসান ও চঞ্চল চৌধুরী এ ছবির মূল আকর্ষণ। ছবির প্রচারণার অভিনবত্বেরও প্রশংসা করতে হয়।

নাসিরুদ্দীন দিলু

চলচ্চিত্র প্রযোজক সদস্য, সেন্সরবোর্ড
পেছন ফিরে তাকালে তিন–চারটি ছবির কথাই মনে পড়ে। এর মধ্যে দেবী ও পোড়ামন ২ মনে হয়েছে পিঠাপিঠি চলেছে। হিসাব করলে দেখা যাবে দেবীই এগিয়ে। বেশির ভাগ ছবিই এখন বৃহস্পতিবার সেন্সর ছাড়পত্র পায়, পরদিন মুক্তি। কোন প্রেক্ষাগৃহে কোন ছবি আসছে, দর্শক জানতে পারে না। অথচ মুক্তির আগে ভারতের ছবিগুলো নিয়ে কত আলোচনা। দেবীর প্রচারণায় ছিল সেই ধাঁচ। ছবির মান যেমন ভালো ছিল, প্রচারণায়ও ছিল অভিনবত্ব। দর্শককে টেনেছে। অভিনবত্ব না থাকলেও পোড়ামন ২ ছবিরপ্রচারণাও ভালো ছিল। নতুন দুজন শিল্পী, তারপরও দর্শক টেনেছে। সময় নিয়ে প্রচারণা করায় মানুষের মাথায় ছবি দুটির নাম ঢুকে গিয়েছিল।

সুদীপ্ত কুমার দাশ

প্রধান উপদেষ্টা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি
বাংলাদেশের পাশাপাশি জয়া আহসান ভারতের কলকাতায়ও সমানতালে কাজ করছেন। কলকাতায় একটি সিনেমার শুটিং মুক্তি পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় তাঁকে লেগে থাকতে দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা জয়া দেবী ছবিতেপ্রয়োগ করেছেন। সফলও হয়েছেন। শুনেছি, মুক্তির আগেই ছবিতে লগ্নি করা টাকা উঠে গেছে। একটি ছবি তখনই সফল হয়, যখন একই দর্শক বারবার দেখেন। দেবী ও পোড়ামন ২ দুটি ছবিতে এই ব্যাপারটি ছিল চোখে পড়ার মতো।

ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ

সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সদস্য, সেন্সরবোর্ড
স্বত্বাধিকারী, মধুমিতা সিনেমা হল আমাদের প্রেক্ষাগৃহে ২৫টি বাংলা সিনেমা মুক্তি দিয়েছি। এর মধ্যে দেবী, পোড়ামন ২ ও ভাইজান এলো রে ছবি তিনটি ভালো ব্যবসা করেছে। তবে এগিয়ে ছিল দেবী। সারা দেশ থেকে পাওয়া তথ্যেও দেখেছি, ব্যবসা ও দর্শকপ্রিয়তায় দেবী ছিল শীর্ষে।

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বুকিং এজেন্ট সমিতি
আমি ছবি বুকিং দিই দেশের ১৫টি প্রেক্ষাগৃহে। এগুলোসহ বাইরেও যা দেখেছি তাতে দেবীর ব্যবসা ছিল দুর্দান্ত। এরপরই ছিল পোড়ামন ২, ভাইজান এলো রে, ক্যাপ্টেন খান, স্বপ্নজাল।