শহীদ মিনারে বাজল মনভাঙা গান

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে শ্রদ্ধা জানান সংগীতশিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে শ্রদ্ধা জানান সংগীতশিল্পীরা। ছবি: প্রথম আলো

শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ। আজ বুধবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে তাঁকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। পরে তাঁর মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী-বন্ধু-স্বজন, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী। সে সময় মনভাঙা সুরে সেখানে বাজতে শোনা যাচ্ছিল ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানটি।

সকালে শহীদ মিনারে উপস্থিত হন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, সহ-উপাচার্য মোহাম্মদ সামাদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, গীতিকার হাসান মতিউর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও কবির বকুল, সংগীতশিল্পী খুরশিদ আলম, সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, মনির খান, সাংবাদিক আবেদ খান প্রমুখ। এ সময় বুলবুলের মরদেহের পাশে ছিলেন তাঁর ছেলে সামির ইমতিয়াজ মুন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের দুই বোন রোকসানা তানজিম মুকুল ও রোয়েনা হাসান মিতুল।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। বাদ জোহর সেখানে প্রথম জানাজার পর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (এফডিসি)। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহের পাশে তাঁর ছেলে সামির আহমেদ। ছবি: প্রথম আলো
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহের পাশে তাঁর ছেলে সামির আহমেদ। ছবি: প্রথম আলো

একটি মরদেহ ও একটি খাতা
সব সময়ের মতো কীর্তিমানদের মরদেহের সঙ্গে শহীদ মিনারে আনা হয় একটি শোকবার্তা লেখার খাতা। ব্যতিক্রম হয়নি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ক্ষেত্রেও। এক অনুরাগী সেই খাতায় লিখেছেন, ‘তোমাকে ভুলে যাওয়ার মতো কিছু একটা দিয়ে যাও। তোমার যা আছে, সবই মনে রাখার মতো। শুধু একটা জানালা খুলে রাখছি, আর সেটা হচ্ছে শ্রদ্ধাভরা হৃদয়ের।’

হাজারো মানুষ এসেছিলেন গীতিকবি বুলবুলকে শ্রদ্ধা জানাতে। কেউ দলবল নিয়ে, কেউ আবার একা। কেউ এসেছিলেন ফুলের ডালা হাতে, কেউ এসেছিলেন কেবল কয়েকগুচ্ছ ফুল হাতে। গীতিকবির মরদেহের সামনে এলে কিছু বলতে অনুরোধ করা হয় শিল্পী সামিনা চৌধুরীকে। এই গীতিকবির লেখা অনেক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। একরকম পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁদের। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে সামিনা চৌধুরী বললেন, ‘তাঁর মুখের দিকে তাকালে এখন মনে হচ্ছে, কী পবিত্র একটি মুখ। এখনই বুঝি বলে উঠবেন “ওই সুরটা গাও”। তাঁর চলে যাওয়ায় আমরা একটি ছায়া হারালাম। তিনি যেখানে গেছেন, সেখানে যেন অনেক ভালো থাকেন। আর আমরা তাঁর কাছ থেকে যা পেয়েছি, তা যেন চর্চা করে যাই।’

শহীদ মিনারে বাজছিল ‘সব কটা জানালা’
একটা মনভাঙা সুরে শহীদ মিনারে বাজতে শোনা যাচ্ছিল সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানটি। সুরস্রষ্টার সুরে সুরে তাঁর কফিনের ওপর শ্রদ্ধার শেষ ফুলটি রাখছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ মানুষেরা। এসেছিলেন এই গানের শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনও। তিনি বললেন, ‘আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে বুলবুলের গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর সুর এক চমৎকার দৃশ্য রচনা করত। দেশের গান যে এত সুন্দর হতে পারে, তা বুলবুলের গান না গাইলে বুঝতে পারতাম না।’

বিদায় হে কিশোর যোদ্ধা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ১৪ বা ১৫ বছর। কিশোর বুলবুল জীবনের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষ করে সেই চেতনাকে বুকের ভেতর লালন করে রেখেছিলেন তিনি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে আরেক মুক্তিযোদ্ধা ক্র্যাক প্লাটুনের সৈনিক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের বিশ্বাস আর চেতনা থেকে কখনোই সরে যাননি বুলবুল। এমনকি তাঁর সব কাজে-কর্মে সেই আদর্শ প্রতিফলিত হতো।’

যুদ্ধের অনেক বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘২০১২ সালে গঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্য দেন তিনি। যার কারণে পরবর্তী সময়ে তাঁর ভাইকে হারান। তাঁর প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল।’

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি বুলবুল। দেশচেতনায় পরিপূর্ণ একজন মানুষকে হারালাম আমরা। অনেক দিন পর্যন্ত তাঁর স্মৃতি আমাদের মনে পড়বে।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় শোকবার্তা লেখার খাতা। ছবি: প্রথম আলো
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় শোকবার্তা লেখার খাতা। ছবি: প্রথম আলো

স্মরণ করলেন সংগীতের স্বজনেরা
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। তিনি বলেন, ‘স্পন্দন ব্যান্ডে বাজাত সে। আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন বাজিয়েছে। আজকের এই পর্যায়ে পৌঁছাতে তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তিনিও থাকবেন।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহের পাশে সার্বক্ষণিক ছিলেন শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। বুলবুলের সুরে অনেক গান গেয়েছেন তিনি। সেগুলোর অন্যতম ‘ও ডাক্তার, আপনি যখন করবেন আমার ওপেন হার্ট সার্জারি’। খুব ঘনিষ্ঠ মানুষটিকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ধরে আসছিল কুমার বিশ্বজিতের। বললেন, ‘আমরা সংগীতের এক মহাজনকে হারিয়েছি। জানি না এই ক্ষতি আমাদের কোন জনমে গিয়ে পূরণ হবে। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আমাকে সমৃদ্ধ করেছেন, বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন।’

বাবার মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় ছেলে সামির আহমেদ বললেন, ‘এই শ্রদ্ধা বাবার প্রাপ্য ছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর যা করা প্রয়োজন, তিনি তাঁর সেই কাজ করে গেছেন। বাকিটা মানুষ করবে।’

গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘বেঁচে থাকা অবস্থায় এ রকম শিল্পীদের জন্য সরকারকে এমন একটি ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা ভালোভাবে বাঁচতে পারেন। মৃত্যুর পর তাঁদের যেন যথাযোগ্য সম্মান করা হয়, সেটাও নিশ্চিত করা দরকার।’

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ জানিয়েছেন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সৃজনকর্ম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে সরকার। তাঁর কাজগুলোকে কপিরাইটের আওতায় আনার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি।