জেমসের পিছু পিছু

গাড়ি থেকে নেমেই কানে আসে শুধু একটা চিৎকার, বারে বারে, কয়েকটা কণ্ঠ থেকে। এগিয়ে যাই, বাড়তে থাকে চিৎকার। কয়েক শ, কয়েক হাজার কণ্ঠে একই ডাক, একই নাম—‘গুরু’; অর্থাৎ জেমস। আর ওদিকে আমরা ছুটছি জেমসের পেছনে। আমাদের তাড়া করছে সেই ডাক। কিন্তু জেমস নির্বিকার। তাঁর পিছে পিছে আমরাও উঠে যাই মঞ্চে। দাঁড়াই পর্দার আড়ালে ব্যান্ড গানের কিংবদন্তি জেমসের পেছনে। ঢাকা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত জেমসের পিছে পিছে আমাদের সেই যাত্রাই উঠে এসেছে এবারের প্রতিবেদনে।
ছবি : খালেদ সরকার
ছবি : খালেদ সরকার

বৃহস্পতিবার খবর পাই, জেমস যাচ্ছেন চাঁদপুর। সেখানে স্থানীয় স্টেডিয়ামে গাইবেন তিনি। খোলা মাঠে শ্রোতাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে স্টেডিয়ামের দরজা। গ্যালারি আর মাঠজুড়ে তাই শ্রোতা টইটম্বুর হয়ে থাকবে এ আর বলার অপেক্ষা থাকে না। আমরা জেমসের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। জানতে চাই সেই কনসার্টের টুকিটাকি। খবর নিই কখন কীভাবে চাঁদপুরে পৌঁছাবেন ভক্তদের ‘গুরু’।

অপেক্ষা
শুক্রবার সড়কপথে দুপুরে রওনা দেন জেমস। তবে ঠিক জায়গামতো তাঁর পিছু নেওয়ার জন্য আমরা তাঁর আগেই পৌঁছে যাই চাঁদপুর। বিকেল থেকে স্থানীয় সার্কিট হাউসে শুরু হয় জেমসের জন্য আমাদের অপেক্ষা। সন্ধ্যা ৬টার দিকে জেমস নামেন সার্কিট হাউসে। তবে তাঁর উপস্থিতির উষ্ণতা আমরা আগে থেকেই আঁচ করতে শুরু করি। কারণ সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ভিড় জমতে থাকে কিছু উৎসাহী ভক্তের। ঠিক তারায় তারায় গানটার ‘ক্যামেলিয়া হাতে এই সন্ধ্যায়’ কথাটার মতো গোলাপ হাতে থাকা কয়েকজন ‘সুন্দরীতমা’কে চোখে পড়ে। জেমস গাড়ি থেকে নামেন একেবারে সাদামাটা পোশাকে। লম্বা সফরের ছাপ দেখা যায় তাঁর চেহারায়, তবে সেটা ক্লান্তি নয়। সেটা কী? সেই উত্তর খোঁজার সুযোগ হয় না আমাদের। শুরু হয়ে যায় আমাদের জেমসের পিছু নেওয়া।

পিছু নেওয়া
সার্কিট হাউসে নেমে বৈঠক ঘরে ঢোকেন জেমস। আমরা তাঁর পিছু নিই। হাত–মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসেছেন তিনি। হন্তদন্ত আয়োজক ও সার্কিট হাউসে কর্মরতরা। জেমস যে একজন অতিথিপরায়ণ ব্যক্তিও, তা আমরা এ যাত্রায় বুঝতে পারি। দূরে বসা আমাদের, অর্থাৎ তাঁর পিছু নেওয়া ঢাকার অতিথিদের তিনি তাঁর ভোজে শামিল করতে দ্বিধা করেন না। নিজের পাতে খাবার তোলার আগে খোঁজ–খবর নেন, ‘তোমরা খেয়েছ তো? আসো, বসো, আমাদের সঙ্গে।’

শোয়ের আগের নিয়মগুলো
দেখলাম জেমসকে দেওয়া হলো কুসুম গরম পানি। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সেটা তো চললই, নিজের ঘরেও এক ফ্লাস্ক কুসুম গরম পানি নিয়ে গেলেন খাবার শেষে। সঙ্গে ঘরে গেল রং চা। গাড়ি থেকে নেমে খাওয়ার সময় অবধি জেমস পরেছিলেন সাদা–কালো কালার কো–অর্ডিনেটেড একটা ঢিলেঢালা শার্ট আর ট্রাউজার, গলায় মাফলার, পায়ে মোজা আর চপ্পল। তৈরি হওয়ার জন্য সময় নিয়ে সার্কিট হাউসে নিজের কামরায় ঢোকেন তিনি। বেরিয়ে আসেন একেবারে ভিন্ন সাজে, ভিন্ন জেমস। হুডি, কানটুপি আর জিনস। মঞ্চে ওঠার আগে তাঁকে একটা ছকের ভেতর থেকে কিছু নিয়ম মানতে দেখি আমরা। যেমন গাড়িতে বসে স্টেডিয়ামে ঢোকার আগে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস নিলেন। গাড়ি থেকে নেমে ভিড় সামলে কোনো কিচ্ছুটি না বলে সোজা গিয়ে ছুঁলেন গিটার। মঞ্চে তাঁর পেছনে একটা চেয়ারে ততক্ষণে সাজিয়ে রাখা হয়েছে লেবু, লবণ আর সেই ফ্লাস্ক ভরা কুসুম গরম পানি। গানের ফাঁকে ফাঁকে গলার আবদার মেটানোর জন্য নিয়ম করেই সাজানো ছিল সেসব। একজন সহকারী একেকটা গান শেষ হলে ফ্লাস্কের মুখে গরম পানি ঢেলে আড়াল থেকে তা তুলে দিচ্ছেন জনস্রোত থেকে ভেসে আসা ‘গুরু’ নামের সেই শিল্পীর হাতে। আর তাতে চুমুক দিয়েই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকে সাড়া দিচ্ছেন সবার প্রিয় ‘গুরু’। হাত উঁচিয়ে জানান দিচ্ছেন স্টেডিয়াম ভর্তি প্রতিটি মানুষের ডাক তিনি শুনতে পাচ্ছেন।

জেমস গাইছেন চাঁদপুর স্টেডিয়ামে। ছবি: খালেদ সরকার
জেমস গাইছেন চাঁদপুর স্টেডিয়ামে। ছবি: খালেদ সরকার

দুই রকম জেমস
আমরা যেই জেমসের সঙ্গে সার্কিট হাউসে দেখা করি আর তাঁর পিছু নিয়ে স্টেডিয়ামে যাওয়া জেমস যেন আলাদা দুই মানুষ। তিনি যখন তৈরি হয়ে নিজের কামরা থেকে বেরোলেন, ঠিক তখন থেকেই আরেক ব্যক্তিত্বের জেমসের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। ব্যক্তি জেমস পোশাক বদলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিত্বেও আনেন তাঁর ‘রকস্টার’ সুলভ আমেজটা। সার্কিট হাউস থেকে আমরা তাঁর সফরসঙ্গী হই। ছাইরঙা মাইক্রোবাসের মধ্যখানের সিটে বসা জেমস আর পেছনের সিটে আমরা। গাড়িতে উঠেই কিছুক্ষণ আলাপ চলে আমাদের। যেমন ‘ফিরবেন কীভাবে?’ জেমস বলেন, ‘এই গাড়িতেই।’ আমরা জানতে চাই, ‘গান শেষে সরাসরি ঢাকার পথে রওনা হবেন?’ এক কথায় জবাব দেনম‘হ্যাঁ।’ এরপর জেমসের প্রশ্নের পালা। তিনি জানতে চান, ‘তোমরা ফিরবে কীভাবে?’ আমাদের জবাব তাঁকে আশ্বস্ত করে। এরপর জেমস সামনের দিকে তাকিয়ে মনোযোগী হন অন্যদিকে। আমরা তখন শিল্পীর বদলে যাওয়া দেখি। তাঁর চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন লম্বা নিশ্বাস নেওয়া দেখি। দেখি নীরব থেকে একনিষ্ঠ ধ্যানে মগ্ন এক শিল্পীকে। পাশে থাকা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তার ওয়াকিটকিতে তখন শোনা যাচ্ছে, ‘রুট ক্লিয়ার, ৫ মিনিটের মধ্যে জেমস ঢুকবেন। একজ্যাক্ট লোকেশন?’
গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘নাও লোকেশন স্টেডিয়াম গেট।’
তবে জেমস নির্বিকার, নিশ্চুপ। গাড়ি থেকে নামার আগে জেমস অপেক্ষা করেন নিরাপত্তাকর্মীদের সবুজ সংকেতের। এই ফাঁকে জিজ্ঞেস করি তাঁকে, ‘কোনো কনসার্টে যাওয়ার আগে কী কী করেন আপনি?’ এই প্রশ্নে শিল্পীর ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে না; বরং খুব সহজভাবেই তিনি বলেন, ‘এই তো যেমনটা দেখছ, প্রতিবার তা–ই করি।’

জেমস
জেমস

যখন মঞ্চে...
চাঁদপুর স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এরপরও জেমসকে পুলিশ আর গোয়ান্দা কর্মকর্তারা নির্বিঘ্নে ঘেরাও দিয়ে নিয়ে যান মূল ফটক থেকে মঞ্চ অবধি। ‘গুরু...গুরু...’ বলে আসা স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষের চিৎকারে আমাদের মন আর মগজ তখন মোহাচ্ছন্ন। যেটা আমাদের জন্য খুব নতুন, সেই মোহে জেমস চার দশক ধরে আবিষ্ট। এমন উন্মাদনা যে–ই শিল্পী এতগুলো বছর ধরে প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করে আসছেন, তাঁর নির্বিকারত্ব দেখে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। সরাসরি মঞ্চে উঠে যান জেমস। হাতে তুলে নেন গিটার। মাইকে ‘লাভ ইউ! তোমাদের ভালোবাসি’ বলে জেমস তাঁর ‘কবিতা’ গানটি শুরু করেন। এরপর একে একে ‘লেইস ফিতা’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘মা’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘বিজলি’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘তারায় তারায়’, ‘মীরাবাঈ’সহ ১২টা গান গেয়ে ফেলেন। তাঁর সঙ্গে স্টেডিয়ামভর্তি উন্মাতাল জনস্রোতও আওড়াতে থাকে সেই গানের কথা। মাঝে মাঝে জেমস যখন চুপ করেন, আমরা পর্দার আড়ালে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে দিব্যি বুঝতে পারি জেমস থেমে গেলেও মঞ্চের ওপাশে থাকা শ্রোতারাই গেয়ে চলেছেন গান, তাঁদের কণ্ঠে। গ্যালারির একেবারে শেষ প্রান্তে চোখ গেলেও দেখা যায় হয়তো বাবা, বা ভাইয়ের কাঁধে চড়ে বসা ছোট্ট মেয়েটাও হাত উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে—সে–ও গাইছে!

কনসার্ট শেষে
১২তম গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেমস বিদায় নেন। ‘ভালো থেকো’ বলে নামিয়ে রাখেন গিটার। ওদিকে পুলিশ আর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা হাতে হাত ধরে প্রস্তুত জেমসকে ঘেরাও দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে শ্রোতারা অদম্য। ভিড় ঠেলে ছুটে আসেন তাঁরা। আমরা জেমসের পেছনেই থাকি। তিনি হাত উঁচিয়ে এগোতে থাকেন আর পেছন থেকে সেই মোহাচ্ছন্ন চিৎকার ‘গুরু...গুরু...’। জেমস সেই চিৎকার পেছনে ফেলে এগোতে থাকেন। কিন্তু উন্মাতাল ভক্তদের অবাধ্য ডাক তাঁর পিছু ছাড়ে না। আমরা পিছু নেওয়া শেষ করি কিন্তু জেমসের গাড়ির পেছনে কালো কাচ ছুঁয়ে কিছু তরুণ দৌড়াতে থাকেন। তাঁরা হয়তো জেমসের সেই ‘দুষ্টু ছেলের দল’।

একনজরে জেমস
পুরো নাম: ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস
বাবা: ড. মোজাম্মেল হক, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন
মা: জাহানারা খাতুন ছিলেন গৃহিণী
জন্ম: ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর, নওগাঁ
সন্তান: এক ছেলে (দানেশ), দুই মেয়ে (জান্নাত ও জাহান)
প্রথম ব্যান্ড: ফিলিংস নগর বাউলের
আত্মপ্রকাশ: ১৯৯৮ সালে
প্রথম অ্যালবাম: স্টেশন রোড (১৯৮৬)
একক অ্যালবামের সংখ্যা: ৮টি
সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যালবাম: কাল যমুনা (২০০৮)
স্বীকৃতি: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন ২০১৪ সালে দেশা: দ্য লিডার ছবির ‘আসছে দেশা আসছে’ গানের জন্য। দুবার জিতেছেন মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার (২০১৪ ও ২০১৭)। একবার সিটিসেল–চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড (২০১৬)