১৫ বছরের 'ব্যাচেলর'

২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি একটা ছবি মুক্তি পেয়েছিল দেশজুড়ে। ছবিটা একাধারে আলোচনা, সমালোচনা আর বিনোদনের খোরাক হয়ে ওঠে মুক্তির পরপরই। এমনকি পরের বছরগুলোয় এ ছবি একটা আলাদা ধারাই তৈরি করে ফেলে। ছবিটির নাম ব্যাচেলর। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি, ফেরদৌস, শাবনূর, অপি করিম, হাসান মাসুদ, ইলোরা গওহরসহ অনেকে। ব্যাচেলর মুক্তির ১৫ বছরে আমরা এর নির্মাতা ও দুই শিল্পীর কাছ থেকে মজার স্মৃতি জানতে চেয়েছিলাম, যা এখনো তাঁদের হৃদয়ে তাজা হয়ে আছে—


সিনেমার গল্পও প্রেমে ঢুকে গেছিল: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
আমি সব সময়ই বলি, আমার সব ছবিই আত্মজৈবনিক, এমনকি অন্যের জীবনের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত ছবিকেও আমি আমার জীবনেরই গল্প মনে করি। তবে ব্যাচেলর একটু বেশিই আত্মজৈবনিক। যে জীবন আমি ও আমার বন্ধুরা যাপন করছিলাম—সেটাই পর্দায় তুলে ধরেছি কোনো রকম ভনিতা ছাড়া। নিজেদের দুঃখ–বেদনার মধ্যে তামাশা খুঁজে পেয়েছি, তবে সেটা লুকানোর চেষ্টা করিনি। ব্যাচেলর–এর শক্তি ছিল বোধ হয় সময়কে ধারণ করার ক্ষেত্রে এর সততায়।

ব্যাচেলর বানানোর সময়ের অনেক গল্পই তো মনে পড়ছে। কোনটা বলা সমীচীন হবে আর কোনটা হবে না—সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় আছি। ছোট করে দুইটা বলতে পারি।

ছবিটা যেদিন মুক্তি পেল, সেদিন সন্ধ্যায় আমি আর মারজুক (রাসেল) শাহবাগ থেকে একটা রিকশা নিয়ে ভয়ে ভয়ে বলাকা সিনেমা হলের দিকে আগালাম, দেখতে যে আদৌ কেউ এই ছবি দেখতে যায় কি না। সেই দিন দুপুরেই ছবিটা চ্যানেল আইতে দেখানো হয়েছে। কে আবার কষ্ট করে সিনেমা হলে যাবে?—এসব ভাবতে ভাবতে বলাকার উল্টা দিকের নিউমার্কেটের গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। উত্তেজনা আর ভয়ে অপেক্ষমাণ। শো ভাঙল। ও মা! দেখি দলে দলে লোক বের হচ্ছে হল থেকে। আমার আর মারজুকের সে কী উত্তেজনা! এখনো সেটা আমার সেরা অনুভূতিগুলোর একটা।

আরেকটা কথা মনে পড়ে। তখন আমার একটা প্রেম চলছিল। সেই প্রেম আর সিনেমা মোটামুটি হাতে হাত ধরে আগাচ্ছিল। অনেক ক্ষেত্রে আগের রাতে প্রেমে যা ঘটছে, পরের দিন সিনেমায় সেটা ঢুকে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো সিনেমার গল্পও প্রেমে ঢুকে গেছিল।

সব শেষে একটু কৃতজ্ঞতার কথা বলতে চাই। আনিসুল হক আমাকে ফরিদুর রেজা সাগরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যাচেলর বানানো হলে ফ্রি প্রমোশন পাওয়া যায় কি না—এই ধান্ধায়। সাগর ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছবি যে বানাচ্ছ, টাকা পাচ্ছ কোথায়?’ আমরা বললাম, ‘এখনো জানি না, পেয়ে যাব।’ উনি বললেন, ‘কত টাকা লাগবে বানাতে?’ আমি মনে যা আসে একটা অঙ্ক বলে দিলাম কোনো বাজেট না করেই এবং উনি সেই দিনই ছবির বাজেট পাস করে দিয়ে যুক্ত হয়ে গেলেন ছবিটার সঙ্গে। প্রথম সিনেমার টাকা পেতে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলতে হয়। সেখানে আমার ক্ষেত্রে ঘটল একেবারে ম্যাজিক।

রাত ১০টায় ‘ব্যাচেলর’–এর কাজ শুরু করতাম: ফেরদৌস

আমি আর শাবনূর তখন একসঙ্গে প্রচুর বাণিজ্যিক ছবির কাজ করছি। এর মধ্যে একদিন ব্যাচেলর-এর জের ধরেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি প্রথম জানিয়েছিলেন, এটা হবে টেলিফিল্ম। কিন্তু তখন আমি টেলিভিশনের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত ছিলাম না। তাই চরিত্র আর গল্প খুব পছন্দ হলেও শুরুতেই অনীহা জন্মায়। পরে চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ভাই প্রযোজনার দায়িত্ব নিলে সিনেমা হিসেবে শুরু হয় ব্যাচেলর–এর কাজ। এখনো মনে আছে, তখন আমি সারাদিন এফডিসিতে গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমার শুটিং করে বারিধারায় এসে রাত ১০টায় ব্যাচেলর–এর কাজ শুরু করতাম। ছবিতে কয়েকটা দৃশ্য ছিল, যেখানে আমাকে শাবনূর আর অপি করিমের সঙ্গে ফোনে ফিসফিস করে কথা বলতে হবে। এরপর আরেকটা দৃশ্য ছিল ঘুমানোর। মজার ব্যাপার হলো, সারাদিন শুটিংয়ের পর এতই ক্লান্ত হয়ে যেতাম যে ওই ফিসফিসিয়ে কথা বলার দৃশ্য করতে গিয়ে আমি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের শট নেওয়ার পর সেটের লোকেরা তো আর আমাকে ডেকেও জাগাতে পারে না। এমন কত যে ঘটনা এই ব্যাচেলর নিয়ে। ভাবতেই অবাক লাগে যে ১৫ বছর হয়ে গেল! সেটা ছিল বাণিজ্যিক ছবির ঘরানা থেকে বেরিয়ে একটা অন্য রকম সিনেমায় আমার আর শাবনূরের অভিনয়। তাই হৃদয়ের খুব কাছেই এই ছবি।

আমি ভেবেছি সরি-টরি বলবে: অপি করিম

১৫ বছর আগের ঘটনা। ওই সময় ৫১বর্তী নাটকের শুটিং করছিলাম। ওটা যে বাড়িতে হতো, ব্যাচেলরও ওই বাড়িতেই শুটিং হয়েছে। এটা তো থার্টি ফাইভ ক্যামেরায় শুটিং হতো। তো, চলচ্চিত্রের একটা দৃশ্য ছিল কান্নার। পরিচালক সরয়ার (মোস্তফা সরয়ার ফারুকী) অ্যাকশন বললেই আমাকে কাঁদতে হবে। অ্যাকশন বলল, কিন্তু আমার আর কান্না আসে না। এভাবে কয়েকবার হলো। এদিকে সরয়ার গেল রেগে। আমার হলো মন খারাপ। আমি পাশের একটা রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। বসে থাকতে পারলাম না। কান্না চলে এল। ঠিক তখনই সরয়ার রুমে ঢুকল। আমি ভেবেছি সরি-টরি বলবে। কিন্তু না, উল্টো বলল, ‘এই কান্নাটা তখন কাঁদলে কী হতো? আমার তো এত কষ্ট করতে হতো না।’ আমি তো অবাক! যাহোক এ রকম হাসি, কান্না আর মন খারাপের মধ্যেই কাজ করেছি।

তবে সিনেমাটা মুক্তির পর সবাই বেশ প্রশংসা করল। আলোচনা হলো। আমি তখন বুয়েটের শিক্ষার্থী। নিউমার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনে দিয়ে বুয়েটের বাসে করে যাতায়াত করি। বলাকায় আমার ছবিসহ বিরাট একটা ব্যানার লাগানো ছিল ওই সময়। বাস থেকে আমি দেখতাম। ভালো লাগত। আরও ভালো লাগত যখন বাসভর্তি সবাই একবার সেই ব্যানারের দিকে তাকাত, আবার আমার দিকে। এটা বেশ উপভোগ্য ছিল আমার কাছে।