মঞ্চে ১৯২৭ সালের পুরানা পল্টন

‘আমরা তিনজন’ নাটকের কারিগরি প্রদর্শনীর একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘আমরা তিনজন’ নাটকের কারিগরি প্রদর্শনীর একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

হুইলচেয়ারে চড়ে এলেন এক প্রবীণ। নাম বিকাশ। সুপরিসর মহড়াকক্ষের ঝকঝকে মেঝের ঠিক মাঝখানে থেমেছেন তিনি। আবৃত্তির ঢঙে সংলাপ আওড়ালেন, ‘আমরা তিনজন। আমি, অসিত আর হিতাংশু; ঢাকায় পুরানা পল্টনে, ১৯২৭-এ। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘে-ঢাকা সকাল! এক পাড়ায় থাকতাম তিনজন। পুরানা পল্টনে প্রথম বাড়ি উঠেছিল তারা-কুটির, সেটা হিতাংশুদের...।’

সোমবারের মাঘ-সন্ধ্যায় শীত খুব একটা জমেনি। মহড়া জমে উঠেছিল। শিল্পকলা একাডেমির প্রশাসনিক ভবনের মহড়াকক্ষে তখন চলছিল বুদ্ধদেব বসু চর্চা। তাঁর লেখা গল্প ‘আমরা তিনজন’-এর দৃশ্যকাব্য। নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকী হাজির হয়েছিলেন খানিক আগে। ব্যস্ত মানুষ। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক তিনি। দাপ্তরিক কাজ শেষ করে চটজলদি নেমে পড়েন নাটকের মহড়ায়। অন্যরা আগে থেকেই তৈরি ছিলেন।

নাটকটিতে অল্প কয়েকটি চরিত্র। বিকাশ (তরুণ ও প্রবীণ), অসিত, হিতাংশু, অন্তরা, দে সাহেব, সুমি, হীরেন বাবু ও ভৃত্য। এ চরিত্রগুলো মঞ্চে পরিবেশন করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন লিয়াকত আলী, মাস্উদ সুমন, ফজলুল হক, আজিজুর রহমান, অনন্যা নীশি, স্বদেশ রঞ্জন দাসগুপ্ত, সোনিয়া আক্তার, জিয়া উদ্দিন শিপন, শিশির কুমার রায়। মজার বিষয় হচ্ছে, ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়; বরং অনেকটা নীরবেই এ নাটকটির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে লোক নাট্যদল। এটি লোক নাট্যদলের ৩৬তম প্রযোজনা।

নির্দেশনার পাশাপাশি বিকাশ চরিত্রে অভিনয় করেছেন লিয়াকত আলী লাকী। ছবি: সংগৃহীত
নির্দেশনার পাশাপাশি বিকাশ চরিত্রে অভিনয় করেছেন লিয়াকত আলী লাকী। ছবি: সংগৃহীত

আমরা মন দিয়ে মহড়া দেখতে থাকি। মন না দিয়ে দেখার উপায়ও নেই। সংলাপগুলো কবিতার মতো। গল্পটা নস্টালজিয়ায় ভরা। বুদ্ধদেব বসু বলে কথা! বলে নেওয়া ভালো, বুদ্ধদেব বসুর এই গল্পটি মূলত লেখা হয়েছে ১৯২৭ সালের ঢাকার পুরানা পল্টনকে ঘিরে। যেখানে থাকতেন তিন বন্ধু—বিকাশ, অসিত আর হিতাংশু। দিনের বেশির ভাগ সময় তিন বন্ধু একসঙ্গে থাকে; যতটা এবং যতক্ষণ থাকা সম্ভব। তিন বন্ধু একসঙ্গে একজনের প্রেমে পড়ল। নাম তার অন্তরা। এই মেয়েটিকে ঘিরেই সারাক্ষণ তিন বন্ধুর নানা রকম জল্পনা-কল্পনা, কথাবার্তা, ভাবনা। নাটকে মূলত হুইলচেয়ারে বসে বর্তমান সময়ের প্রবীণ বিকাশ ১৯২৭ সালের স্মৃতিচারণা করছিলেন।

মহড়াকক্ষের এদিক-ওদিক নাটকের অনুষঙ্গ (প্রপস)। একটা পুরোনো সাইকেল দেখা গেল বেশ কায়দা করে বানানো, তিনজন বসে চালানোর উপযোগী। আছে হুইলচেয়ার, ইজিচেয়ার, ছাতা। মহড়ায় বিকাশ হয়ে গল্পের শুরু করে দিয়ে আবার নির্দেশনায় চলে যান লিয়াকত আলী লাকী। এবার তরুণ তিন বন্ধু আসে এবং ফিরে যায় ১৯২৭ সালের পল্টনে। তিন বন্ধু সাইকেলে ঘুরে বেড়ায় ঢাকায়। কোনো দিন বিখ্যাত ঘোষ বাবুর দোকানে চপ-কাটলেট খায়, কোনো দিন সিনেমা দেখে, কোনো দিন চিনাবাদাম পকেটে নিয়ে নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়, পল্টনের মাঠে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকে।

তরুণ বিকাশের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন, তিনি মাস্উদ সুমন। কথা বলাবলির একপর্যায়ে এই তরুণ বলেন, ‘মেয়েটি দেখতে অনেকটা মোনালিসার মতো। তিন বন্ধুর মধ্যে এ নিয়ে অনেক কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তাঁদের কাছে মেয়েটির নাম হয়ে যায় “মোনালিসা”। একদিন এই মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয় তিন বন্ধুর। বৃষ্টিমুখর সেই দিনে মোনালিসার বাড়ি যায় তাঁরা, কিন্তু অন্তরা বা মোনালিসার সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলতে পারে না। এর মধ্যে একদিন জানতে পারে মোনালিসা টাইফয়েডে আক্রান্ত। মোনালিসার বাবা-মা অসহায়ের মতো তিন বন্ধুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।’

মহড়াকক্ষের ঠিক মাঝখানে পাশাপাশি ৪টি চেয়ার রেখে খাটের মতো করে বানানো হয়। সেখানে দেখা যায় তিন বন্ধু মিলে মেয়েটির শুশ্রূষা করছে। দিন-রাত প্রায় এক মাস পরিশ্রম করে তাঁরা মেয়েটিকে সুস্থ করে তোলে এবং এই সময়ে মেয়েটির সঙ্গে তাঁদের একটি আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। তারপর একদিন মোনালিসা সুস্থ হয়। তিন বন্ধুর খুবই মন খারাপ হয় এই জন্য যে, তারা মোনালিসার ঠিকানা রাখেনি। হঠাৎ একদিন মোনালিসার মা তাদের ডেকে বলল, ‘একবার তোমরা ওর জন্য অনেক খেটেছ, আরেকবার খাটতে হবে, আগামী ২৯ অঘ্রান তাঁর বিয়ে। খবরটি শুনে তিন বন্ধু হতভম্ব হয়ে যায়। বিয়ের পর মোনালিসা চলে যায় কলকাতায়।’

মহড়া দেখতে দেখতে এক সময় মন খারাপ হয়। একদিন হঠাৎ মোনালিসার মা খবর দেয় যে, মোনালিসা আসছে ঢাকায় এবং সে অন্তঃসত্ত্বা। অন্তঃসত্ত্বা মোনালিসাকে ঢাকায় রেখে কলকাতা ফিরে যায় স্বামী হিরেন বাবু। তিন বন্ধু মোনালিসাকে সময় দেয়, ও যাতে ভালো থাকে, কখনো মন খারাপ না করে, সেই চেষ্টাতেই দিন কাটে তিন বন্ধুর। কিন্তু এক অমাবস্যার রাতে ঘটে যায় অঘটন!

মহড়ায় ‘আমরা তিনজন’। ছবি: সংগৃহীত
মহড়ায় ‘আমরা তিনজন’। ছবি: সংগৃহীত

সেই অঘটনের বর্ণনা দিয়ে আবার বর্তমানে ফিরে আসে প্রবীণ বিকাশ। এবারও কবিতার মতো বলে যায়, ‘আমি এখনো আছি, ঢাকায় নয়, পুরানা পল্টনে নয়, উনিশ শ সাতাশ কি আটাশে নয়, সেসব আজ মনে হয় স্বপ্নের মতো, সেই মেঘে ঢাকা সকাল, দুপুর, সেই বৃষ্টি, সেই রাত্রি, সেই—তুমি! মোনালিসা, আমি ছাড়া আর কে তোমাকে মনে রেখেছে!’ মহড়াকক্ষে তখন পিনপতন নীরবতা। সবাই মিশে আছে গল্পে।

মহড়া দেখে মনে হয়, কাব্যনাটক না হলেও এ নাটকের সংলাপগুলো উঁচু মানের কাব্যভাষায়। সে ভাষা ছন্দময় ও অলংকার সমৃদ্ধ। প্রতিটি সংলাপ যেন এক একটা সার্বভৌম কবিতা।

ছয় মাস ধরে নাটকটির কাজ করছে লোক নাট্যদল। সর্বশেষ গত বুধবার সন্ধ্যায় নাটকটির একটি কারিগরি মঞ্চায়ন করে লোকনাট্য দল। নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকী জানালেন, এর মধ্যে দুটি কারিগরি মঞ্চায়ন করার পরিকল্পনা আছে তাঁদের। ফেব্রুয়ারিতে মিলনায়তন বরাদ্দ পেলে দর্শকের জন্য প্রথম প্রদর্শনী করা হবে নাটকটির। এবারই প্রথম নয়, লোক নাট্যদল এর আগেও বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম মৌলিক নাটক ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’ মঞ্চে এনেছিল এবং প্রায় অর্ধশতাধিক প্রদর্শনী করেছে।