শিল্পীরা কারও বাবার সম্পত্তি না: ইমন

ইমন চক্রবর্তী। ছবি: সুমন ইউসুফ
ইমন চক্রবর্তী। ছবি: সুমন ইউসুফ

দেড় ঘণ্টা গান গাওয়ার কথা, গেয়েছেন পৌনে দুই ঘণ্টা। এরপরও আয়োজকদের হাতে গোনা কয়েকজন সন্তুষ্ট নন। তাঁদের কথা, আরও গাইতে হবে। কিন্তু ইমন চক্রবর্তী আর গাইতে চাইছিলেন না। এ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর পৌরসভার কয়েকজন কর্মকর্তা অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের হওয়ার প্রধান ফটক বন্ধ করে দেন। এমনকি একটা রুমে শিল্পীকে আটকেও রাখা হয়। পরে স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টায় সেই যাত্রায় রক্ষা পান তিনি। তবে কৃষ্ণনগর পৌরসভার এমন আচরণে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ। আয়োজকদের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি। আটকে থাকা অবস্থায় গাড়ির ভেতর থেকে ফেসবুকে লাইভ করেন তিনি। সেখানে তিনি ঘটনার সমস্ত বিবরণ দেন।

আজ সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে ইমন জানান, ‘আমি কৃষ্ণনগর ও কলকাতার লিলুয়াহ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। আইনগত ব্যবস্থা যা নেওয়ার আমি নেব। আমি এসবের প্রতিকার দেখে ছাড়ছি।’

‘তুমি যাকে ভালোবাসো, স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো, তার জীবনে ঝড়, তোমার কথার শব্দদূষণ, তোমার গলার স্বর, আমার দরজায় খিল দিয়েছি, আমার দারুণ জ্বর, তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর, তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর’—ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘প্রাক্তন’-এর এই একটি গান ইমন চক্রবর্তীকে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও পরিচিতি এনে দেয়। এই গানের জন্য তিনি অর্জন করেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর পৌরসভায় একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন এই শিল্পী। তাঁকে আটকে রাখাও হয়। পরে এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়।

ক্ষিপ্ত ইমন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমি গান গাইতে গেছি। গান গেয়ে মানুষের মধ্যে ভালোবাসা বিলিয়ে যাব। আমরা তো বিনোদন পণ্য না। বাহ, আয়োজক বলবে, দরজা বন্ধ করে দে। দেখি কীভাবে এখান থেকে যাস! সাধারণ দর্শকের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। অত্যন্ত ভালো দর্শক ছিলেন। তারাই আমাদের উদ্ধার করেছেন।’

ইমন এও বলেন, ‘কৃষ্ণনগরবাসীর প্রতি আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমার যত অভিযোগ পৌরসভার ওই সব অসভ্য-বর্বর লোকদের প্রতি, যাঁরা মনে করেন, শিল্পীরা তাঁদের বাপের সম্পত্তি। আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি কারও বাপের সম্পত্তি নই। আমরা শিল্পীরা আপনাদের কারও বাবার সম্পত্তি নই। আমরা আপনাদের কারণে বেঁচে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকি, তার মানে এই নয় যে, আপনারা যা খুশি আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করবেন। আমার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আজ আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা অন্যদের সঙ্গেও হতে পারে। তাই বলছি, সব শিল্পী এবং বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষের এই ধরনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হবে না। আপনারা যাঁরা আমায় ভালোবাসেন, যাঁরা ভালোবাসেনও না, তাঁরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। কৃষ্ণনগর পৌরসভার কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন প্লিজ।’

অপমানিত ও ক্ষুব্ধ ইমন বলেন, ‘আমার কাছে লিখিত ক্ষমা না চাইলে ওদেরকে ছাড়ব না। আমি যত জায়গায় কথা বলার, বলব। একজন শিল্পী হিসেবে এমন অত্যাচার দিনের পর দিন মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমরা কারোর কেনা সম্পত্তি না। শিল্পীদের মুডের একটা বিষয় আছে। শিল্পীদেরও একটা হৃদয় আছে। তাদের চোখে জ্বল আসে। শিল্পীদেরও একটু হাসতে ইচ্ছে করে। বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। একজন শিল্পীকে আটকে রাখবে! কত্ত বড় সাহস! একজন শিল্পীকে পয়সা দিয়েছি বলে আটকে রেখে দিয়েছি। খুব ভালো লাগছে, তাই না। আরে কেয়া বাত। আরে দারুণ।’

কৃষ্ণনগর পৌরসভার কিছু কর্মকর্তার ওপর ক্ষিপ্ত হলেও সেখানের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী ইমন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘কৃষ্ণনগরের মানুষ আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি সবাইকে বলতে চাই, শিল্পীদের যদি একটু হলেও ভালোবাসেন, বাংলা সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হন, তাহলে আপনারা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। আমি বাজে শব্দ ব্যবহার করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। যাঁদের হয়ে আমরা অনুষ্ঠান করতে আসি, নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের। ভালো ব্যবহার করার দায়িত্ব। একজন শিল্পী কত দূর থেকে এসেছেন, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই। অসভ্যতা এবং নোংরামির চূড়ান্ত জায়গায় চলে যাচ্ছে সো কলড স্টেজ শো। আমাদের শিল্পীদেরও কঠোর প্রতিবাদ করতে হবে।’

ইমন জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কনসার্ট করতে গিয়ে শিল্পীরা প্রায়ই এ রকম হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এর আগেও সৌমলতা, মেখলা দাশগুপ্তসহ আরও কয়েকজন শিল্পী হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এ রকম পরিস্থিতি থেকে শিল্পীরা কবে রেহাই পাবেন, সেটাই এখন প্রশ্ন।