শ্রেষ্ঠাংশে অপু-ফারিয়া

স্বামী হারুনুর রশীদের সঙ্গে শবনম ফারিয়া। ছবি: সুমন ইউসুফ
স্বামী হারুনুর রশীদের সঙ্গে শবনম ফারিয়া। ছবি: সুমন ইউসুফ
>
সম্প্রতি বিয়ে করেছেন অভিনয়শিল্পী শবনম ফারিয়া। তাঁর স্বামী হারুনুর রশীদকে পরিচিতজনেরা চেনেন অপু নামে। অপু বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করেন। একসময় দুজন ছিলেন ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। তারপর? কেমন করে গাঁটছড়া বাঁধলেন দুজন? নবদম্পতির মুখোমুখি বসেছিলেন মো. সাইফুল্লাহ

 আপনাদের দুজনের গল্প নিয়ে যদি সিনেমা বানানো হয়, প্রথম দৃশ্যে আমরা কী দেখব?

 ‘একটা ব্রেকআপ।’ উত্তর আসে শবনম ফারিয়ার কাছ থেকে।

সে কী! বিরতির আগেই বিরহ? আমরা তো প্রেমের গল্প শুনব বলে বসেছি।

 ‘না না, ব্রেকআপ না। ব্রেকআপের আট মাস পর দুজনের দেখা।’ ফারিয়া শুধরে নেন। পাশে বসে সায় দেন তাঁর স্বামী অপু। গল্প এগোয়। একটু একটু করে দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

লোকেশন: বনানী। সময়: দুপুর। চরিত্র: অপু ও ফারিয়া।

এর আগের ৮ মাসে দুজনের যে দেখা হয়নি, তা নয়। ফারিয়া বলছিলেন, ‘যতবার বনানী গেছি, ততবার দেখা হয়েছে।’ পুরোনো প্রেমিকাকে দেখে অপু প্রতিবার ভ্রু কুঁচকেছেন। আর পাকা অভিনেত্রী ফারিয়া নিজের সব অনুভূতি লুকিয়ে রেখে হাসি-হাসি মুখ করে বলেছেন, ‘কেমন আছ? খুব শুকিয়ে গেছ দেখছি...!’ কথাবার্তা এর চেয়ে বেশি খুব একটা এগোয়নি।

৮ মাস পরের সেই আলাপে হঠাৎ কী যেন হয়েছিল ফারিয়ার। বলেছিলেন, ‘আমি এখনো লাঞ্চ করিনি। খাবে আমার সঙ্গে?’ অপুও কী মনে করে সায় দিয়েছেন। খেতে খেতে টুকটাক কথা হয়েছে। তারপর?

ফারিয়া বলেন, ‘ফেরার সময় দেখি অপু চট করে রিকশায় উঠে চলে গেল। একবার ফিরেও তাকাল না।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় তাঁর সেই সময়ের অনুভূতি—‘থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা: চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।’

পুরান চাল যেমন ভাতে বাড়ে, পুরোনো প্রেম বাড়ে দূরত্বে। চেনা লোকটা অচেনা হয়ে যাচ্ছে, সেটাই বোধ হয় মানতে পারেননি ফারিয়া। আবার যোগাযোগ শুরু হলো দুজনের। এর কিছুদিন পর ফারিয়ার ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখা গেল, তিনি লিখেছেন, ‘অপরিচিত কাউকে বিয়ে করার চেয়ে এক্স বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করা ভালো।’ বন্ধুরা যাঁরা আগে থেকেই বিষয়টা জানত, কারও বুঝতে বাকি রইল না, একটা কিছু ঘটতে চলেছে।

২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হয়েছিল আংটি বদল। ঠিক ১ বছর পর, ১ ফেব্রুয়ারি ধুমধাম করে বিয়ে হলো দুজনের।

শবনম ফারিয়া ও তাঁর স্বামী অপু
শবনম ফারিয়া ও তাঁর স্বামী অপু


ফ্ল্যাশব্যাক
সিনেমার শুরুটা ফারিয়া বললেন। প্রেমের শুরু শুনি অপুর মুখে, ‘ফেসবুকে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে এক শর বেশি “মিউচুয়াল ফ্রেন্ড” দেখে বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করেছিল। একদিন কী ভেবে যেন মেসেঞ্জারে লিখলাম, “হ্যালো”। ওপাশ থেকে উত্তর এল, “দেখেন, আমি খুব হতাশার মধ্যে আছি। কখন কী বলে ফেলি ঠিক নেই! ”’

ফারিয়া তখন সবে তারকাখ্যাতি পেতে শুরু করেছেন। একজন নায়িকা এত সোজাসাপ্টাভাবে মনের ভাব প্রকাশ করবেন, অপু একেবারেই প্রত্যাশা করেননি। গল্প জমে উঠল। ইনবক্সে চলল আলাপন। একদিন ঠিক হলো, দুজন দেখা করবেন।

তখন শীতকাল। সকাল ৭টার সময় প্রথম দেখা হয়েছিল দুজনের।

 ‘তুমি একটা হুডি পরে এসেছিলে।’ বলছিলেন অপু।

 ‘আর তুমি? গায়ে জড়ানো ছিল একটা শাল। প্রথম দেখায় কেউ শাল পরে আসে?’ ফারিয়ার জবাব।

তারপর আর কী, যা হওয়ার তা-ই হলো। শীতের পর এল বসন্ত! 

ক্রমশ এ গল্পে...
বসন্তের আগমন অবশ্য অত সহজ ছিল না। পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই দুজনের ভালো বন্ধুত্ব হলো। সম্পর্ক উত্তীর্ণ হলো ‘আপনি’ থেকে ‘তুই’-এ।

কী কথা হতো তখন?

 ‘তেমন কিছু না।’ ফারিয়া বলেন, ‘আমি বলতাম, অমুক ভাইকে দেখে ক্রাশ খেয়ে গেছি। অপু বলত, তমুক মেয়েকে ভালো লেগেছে...’

সম্পর্কটা এতই সহজ হয়ে গিয়েছিল, একদিন অপু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, ‘২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যদি তুই একটা বয়ফ্রেন্ড জোটাতে না পারিস, তাহলে আমিই তোর সঙ্গে প্রেম করব।’ ফারিয়া ভেবেছিলেন, এটাও বন্ধুর হাজার দুষ্টুমির মধ্যে একটা। কিন্তু ২৬ ডিসেম্বর থেকে সত্যিই অপুর কথায় সম্পর্কটা ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা চোখে পড়তে লাগল।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৫, সেদিন ফারিয়ার শুটিং ছিল। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তাঁকে এগিয়ে দেওয়ার সময় অপু আইপ্যাড খুলে বসলেন। তারপর?

 ‘আমি যেহেতু বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করি, নিয়মিত বিভিন্ন পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানাতে হয়। ভাবলাম যে কাজটা আমি ভালো পারি, সেটা দিয়েই ওকে প্রস্তাব দিই। ফারিয়ার ছবি, ভালো লাগা, পছন্দের বিষয়, ওর ক্রাশ, সবকিছু মিলিয়ে একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছিলাম। সব শেষ স্লাইডে ছিল, এই মানুষটির সঙ্গে যদি আমিও যোগ হতে চাই, যদি একসঙ্গে এগোতে চাই, ওর কোনো আপত্তি আছে কি না।’

আপত্তি নেই, সে কথা মুখ ফুটে বলতে হয়নি। ফারিয়া হেসেছিলেন। হাসি দেখেই অপু যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন।

বাহ! সিনেমার এই পর্যায়ে এসে একটা গান না হলে চলে? আপাতত ফারিয়া অভিনীত দেবী সিনেমা থেকেই ধার করে বলি, ‘ক্রমশ এ গল্পে আরও পাতা জুড়ে নিচ্ছি, দুমুঠো বিকেল যদি চাও ছুড়ে দিচ্ছি...’

দেবী ছবির প্রদর্শনীর পর অপুকে জড়িেয় ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারিয়া
দেবী ছবির প্রদর্শনীর পর অপুকে জড়িেয় ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারিয়া


বাবার ছায়া
দুমুঠো বিকেলে একমুঠো মান-অভিমান তো থাকবেই। দর্শককে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো যথেষ্ট উত্থান-পতন, ঝুটঝামেলা আছে ফারিয়া-অপুর এই ‘সিনেমায়’। তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে প্রেম কম, বন্ধুত্ব বেশি। এটা-ওটা নিয়ে ঝগড়া হয়েছে বহুবার। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মনে হয়েছিল, নাহ, সম্পর্কটা আর এগোনো যাচ্ছে না। একেবারে চুকেবুকে যাওয়া প্রেম নবায়ন হয়েছে ৮ মাস বিরতির পর। যার পেছনে বড় অবদান আছে ফারিয়া ও অপুর বাবার।

ফারিয়া বলেন, ‘অপুকে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য প্রায়ই আমি ওর বাসার টিঅ্যান্ডটিতে ফোন করতাম। ফোন ধরতেন ওর বাবা। সব সময় দু–তিন মিনিট কথা হতো। তিনি যখন হাসপাতালে ভর্তি হলেন, আমি দেখতে গিয়েছিলাম। প্রায় এক–দেড় ঘণ্টা গল্প করেছি। এর দুই দিন পর তিনি মারা যান। আবার আমার বাবাও মৃত্যুর ১৫ দিন আগে অপুকে ডেকে নিয়েছিলেন। তখন আমাদের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু বাবা অপুকে পছন্দ করতেন, অপুও বাবার খুব ভক্ত। মৃত্যুর আগে বাবা ৭ দিন হাসপাতালে ছিলেন, ৭ দিনই অপু তাঁকে দেখতে গেছে।’

দেবী সিনেমার উদ্বোধনী প্রদর্শনীর পর ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড করেছিলেন ফারিয়া। ছবিতে দেখা যায়—চারদিকে অনেক মানুষের কোলাহল, মাঝখানে অপুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন ফারিয়া। সবাই যখন প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, তখন দেবী সিনেমার নিলুর নাকি বারবার মনে হচ্ছিল, এই আনন্দের দিনটা যদি বাবা দেখে যেতে পারতেন! যে মানুষটার মধ্যে বাবার ছায়া দেখতে পান, তাঁকে কাছে পেয়েই আর নিজেকে সামলাতে পারেননি শবনম ফারিয়া।

একই সঙ্গে হারানোর দুঃখ আর পাওয়ার তৃপ্তি আছে এই ছবিতে। এটিই কি আমাদের সিনেমার শেষ দৃশ্য হতে পারে?