'টাকার বিনিময়ে ছবির সেন্সর দেওয়া হয়'

>
রাজিবুল হোসেন। ছবি: দীপু মালাকার
রাজিবুল হোসেন। ছবি: দীপু মালাকার
সেন্সর বোর্ডে সিনেমা জমাই হয়নি। কিন্তু মুক্তির তারিখ ঘোষণা করা হয়ে গেছে। ঢালিউডে এ রকম ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। অন্যদিকে সেন্সর বোর্ডে প্রায় দুই বছর আটকে ছিল অ্যাডভেঞ্চারভিত্তিক ছবি ‘হৃদয়ের রংধনু’। কেন? কী এমন ছিল সেই ছবির ভেতরে, যে জন্য নির্মাতাকে যেতে হয়েছিল উচ্চ আদালত পর্যন্ত? ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার মাত্র একটি হলে মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। এ ছবির শুরু, আটকে যাওয়া, নির্মাতা হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা, সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে আইনি লড়াই ও ক্যারিয়ার নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন তরুণ নির্মাতা রাজিবুল হোসেন।

পড়ানো বন্ধ করে সিনেমা বানাতে এসেছিলেন কেন?

সিনেমা বানাতে চাই বলেই নাটক ও নাট্যতত্ত্বে ভর্তি হয়েছিলাম। সে সময় বাংলাদেশে সিনেমার কোনো একাডেমিক জায়গা ছিল না। দেশের বাইরে যে জায়গাগুলো ছিল, সেগুলো ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দুই–একটা জায়গায় বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এফটিআই) আমাদের সময়ে তিন বছরের বৃত্তি দেওয়া বন্ধ রেখেছিল। দেখলাম সিনেমাই যদি বানাতে হয়, আমাকে একাডেমিক পড়ালেখার মধ্য দিয়েই যেতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামটাই আমার জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল।

রাজিবুলহোসেন। ছবি: দীপু মালাকার
রাজিবুলহোসেন। ছবি: দীপু মালাকার

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াতেন আপনি। সে জন্য চলচ্চিত্র নিয়ে আরও পড়াশোনা করতে হয়েছিল নিশ্চয়ই?
বিস্তর পড়ালেখা করতে হয়েছিল। শিক্ষকতা শুরু করি ২০০৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ২০০৯ সালে যোগ দিই ইউল্যাবে। ২০১২ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়িয়েছি। এই সময়ে আমি নিজেকে বদলে ফেলি। এক অধ্যাপক ড. জুড হেনিলো আমাকে শিক্ষিত করে তোলেন। সাধারণ শিক্ষক থেকে তিনি আমাকে একাডেমিশিয়ান করে ফেলেন। পড়ানো, প্রশিক্ষণ দেওয়া, সিলেবাস তৈরি ও সেগুলোর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একাত্ম করার কাজগুলো তিনিই আমাকে শেখান।

এই সময়ের মধ্যে পরিচালনার কাজ করেননি?
এনজিও, টিভি ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার জন্য ফ্রিল্যান্স কাজ করেছি। টিভিসি বানাইনি। আমার কিছু এথিক্যাল সমস্যা আছে। ফলে টিকে থাকার জন্য একটা সেফ জোন তৈরি করে নিয়েছিলাম। নিজের রুচির সঙ্গে মানানসই নয়, সেই কাজগুলো বাদ দিয়ে বাকি কাজগুলো করেছি।

প্রথম ছবিটা হলো না কেন?
ওই ছবিটার সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমাজের প্রতি যথেষ্ট দায়বদ্ধ মনে হয়নি। আমার ৪৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছিল। নৈতিকতার সঙ্গে আপস করে কাজটা করতে পারতাম না। সেসব কারণেই আমার ছবিতে কোনো তারকা নেই। ২০১৩ সালে আমরা শুরু করি ‘হৃদয়ের রংধনু’।

ছবিটা আটকে গেল কীভাবে?
ছবিটি সেন্সরের জন্য জমা দিই ২০১৬ সালে। তাঁরা ছবি সেন্সর ছাড়পত্র না দেওয়ার আটটি কারণ দেখিয়েছেন, যার চারটি সিনেমাতেই অনুপস্থিত। কীভাবে দেখলেন তাঁরা? সমস্যাটা আসলে নৈতিক। সেখানে টাকার বিনিময়ে ছবির সেন্সর দেওয়া হয়। আমি বলেছিলাম, অনৈতিকভাবে আমি এক টাকাও কোথাও ব্যয় করব না। চাইলে সারা জীবন ছবি আটকে রাখতে পারে। টাকার ব্যাপারটা কেউ স্বীকার করে না। কেন জানি না! অনৈতিকভাবে টাকা খরচ করব না বলে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছি। কেন টাকা দেব? পড়াতে গিয়ে আমি কি ছাত্রছাত্রীদের বলব যে, ছবি ছাড়াতে সেন্সর বোর্ডকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। এটা টাকার নয়, অবস্থানের ব্যাপার। দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের এখানকার চলচ্চিত্রকারের এই চর্চাটাই করে আসছেন। কিন্তু কেউ স্বীকার করে না ভয়ে। যদি তাঁদের পরের ছবি আটকে দেয়। আমি জানি, আমার পরের ছবিগুলো সেন্সর বোর্ডে আটকাবে। তাই বলে আমি ছবি বানাব না? সেন্সর বোর্ড সিনেমাকে আটকাতে পারে, চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আটকাতে পারে না।

অনেক দিন পর একত্র হয়েছিলেন ‘হৃদয়ের রংধনু’ ছবির অভিনয় শিল্পীরা। ছবি: দীপু মালাকার
অনেক দিন পর একত্র হয়েছিলেন ‘হৃদয়ের রংধনু’ ছবির অভিনয় শিল্পীরা। ছবি: দীপু মালাকার

তাহলে সেন্সর বোর্ড তুলে দেওয়া উচিত?
একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতার অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। এক. তারকা নিয়ে কাজ না করা। দুই. নিজের মতো করে প্রোডাকশন টিম তৈরি করা। যেমন আমার টিমেই মাত্র ৪ জন লোক ছিল। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য সেন্সর বোর্ড সব সময়ই একটা বাধা। সেন্সর করা মানে কখনোই মুক্ত বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে দেওয়া হবে না। সেন্সর প্রথাটা স্বাধীনতাকে দমন করার জন্য। ‘আমরা সেন্সরের মাধ্যমে অনেক কিছু ছেড়ে দিচ্ছি’—এই কথা বলে নিজেদের বড় করার কিছু নেই। সেন্সর বোর্ড রাখা মানেই স্বাধীনতাকে আটকে দেওয়া। ফলে এই প্রতিষ্ঠানটিই রাখা উচিত নয়। এটা সাংস্কৃতিক বিষয়। আপনি আইন দিয়ে সেটাকে ঠেকিয়ে দিতে পারেন না।

শেষ পর্যন্ত ছবি মুক্তি পাচ্ছে। যেহেতু টাকা বিনিয়োগ করেছেন, শেষ পর্যন্ত এটা ব্যবসা। টাকা তুলতে পারবেন?
আমার কাছে শেষ পর্যন্ত এটা ব্যবসা না। তবে যদি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবনার কথা জানতে চান, বলব আমি আসলে এই ছবিটার প্রদর্শনী করে পরের ছবির জন্য কিছু টাকা তুলতে চাই। আমার বিশ্বাস আমি সেটা পারব। আমাদের দেশে ছবি পরিবেশনপদ্ধতি ভালো না। এই যে পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ভেঙে গেছে, সিনেমা হলগুলো স্বচ্ছ না, এর পেছনে অনেকগুলো পক্ষ আছে। আপনাকে প্রযোজক সমিতির কাছ থেকে তারিখ নিতে হবে, যেখানে তারিখ কেনাবেচা হয়। বুকিং এজেন্টের মাধ্যমে হলে ছবি চালাতে হবে। এই এজেন্টেরা আপনার কাছ থেকে কমিশন নেবে, হলের কাছ থেকেও নেবে। হল মালিক ছবি চালানোর পর টিকিটের স্বচ্ছ হিসাব আপনাকে দেবে না। ১০০ টাকার টিকিট বিক্রি করে আপনাকে দেবে ১৫ টাকা। একটা টিকিট যদি ১০০ টাকা হয়, প্রযোজক পর্যন্ত আসতে আসতে যে টাকা আসে, তাতে একটা সুপারহিট ছবির প্রযোজকও তাঁর মূলধন ফেরত পান না।

সংবাদ সম্মেলনে ছবি মুক্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন শিল্পীরা।
সংবাদ সম্মেলনে ছবি মুক্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন শিল্পীরা।

টাকা তুলবেন কীভাবে?
আমরা জানি, আমাদের দর্শক কারা। আমরা দর্শক জরিপ করেছি। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে ওই জায়গাগুলোতেই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করব, যেখানে কিছু দর্শক আসবে। শুক্রবার থেকে ১ সপ্তাহের জন্য সিনেপ্লেক্সে ছবিটি মুক্তি দিচ্ছি। কিন্তু পরে সারা দেশে বিকল্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করব। সেটাই হবে আমাদের আসল জার্নি। বিকল্প পদ্ধতিতে দেখালে টিকিট যদি ৩০ বা ৫০ টাকাও হয়, সেই টাকাই আসলে আমার সংগ্রহে থাকবে। খরচ বাদ দিয়ে যদি ১ টাকাও থাকে, সেটা সততার টাকা।

পরের ছবি নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
দুটো ছবি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এর একটি ‘রানওয়ে ২০/০২’। এটাও একটা নতুন চ্যালেঞ্জ আমার জন্য। বাংলাদেশে এ রকম ছবি আগে হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একটি বিমান দুর্ঘটনা থেকে ছবির গল্প তৈরি হবে। এটি হবে একটি গবেষণাধর্মী ছবি, ফিকশন-নন ফিকশনের মিশেলে।

একজন তরুণ স্বাধীন নির্মাতা হিসেবে নতুনদের প্রতি আপনার কোনো টিপস?
জীবনে কিছু পেতে চাইলে আপস করা যাবে না। আপস করলে দাসত্ব বরণ করতে হবে। যাদের দেখা যাচ্ছে চারপাশে, সবাই দাসত্ব বরণ করে আছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো শৈল্পিক জায়গায় দাসত্ব চলে না।