ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি হয়েছে কম

জীবন থেকে নেয়া ছবিতে অভিনয় করেছেন খান আতাউর রহমান ও রওশন জামিল
জীবন থেকে নেয়া ছবিতে অভিনয় করেছেন খান আতাউর রহমান ও রওশন জামিল

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশের যে গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, তা খুব কমই উঠে এসেছে সেলুলয়েডের পর্দায়। আতশি কাচের সাহায্য নিয়েও ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে বা এর ইতিহাস নিয়ে হাতে গোনা দুই থেকে তিনটির বেশি চলচ্চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে! সর্বশেষ গত সপ্তাহে ক্ষুদ্র এই তালিকায় যোগ হলো তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ফাগুন হাওয়ায় ছবির নাম। চলচ্চিত্র গবেষক এবং লেখক অনুপম হায়াতের কাছে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে কেন চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়া উচিত—জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘শুধু চলচ্চিত্র কেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, অঙ্কন—সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় সবকিছুই হওয়া উচিত। ভাষা আন্দোলন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। এ জন্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এসেছে। এটা একটা আণবিক শক্তি, যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ হলো মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু যাঁরা বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, তাঁরা আজ নেই। আর এখন যাঁরা আছেন, তাঁরা কেবল লাভ, লোভ আর খ্যাতির পেছনে ছুটছেন।’

ভাষা নিয়ে দুটি ছবি

জীবন থেকে নেয়া (চলচ্চিত্র, ১৯৭০)
পরিচালক:
জহির রায়হান
অভিনয়ে: রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

এই চলচ্চিত্রে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ প্রভৃতি গান ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে ধারণ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বাংলার মানুষকে। বড় বোনের চরিত্রে রওশন জামিলকে অত্যাচারী, শাসক হিসেবে দেখানোর মধ্য দিয়ে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানকেই রূপক অর্থে দেখানো হয়। ‘পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চলচ্চিত্র’ এই অভিযোগে চলচ্চিত্রটির শুটিংয়ের সময় জহির রায়হানকে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু পরে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী।

বাঙলা (চলচ্চিত্র, ২০০৬)
পরিচালনা:
শহীদুল আলম খোকন
অভিনয়ে: শাবনূর, হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ প্রমুখ।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাবন্ধিক এবং চিন্তাবিদ আহমদ ছফার ওঙ্কার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র একজন বোবা স্ত্রী। কেবল ভাষার মিছিলই সেই নারীকে চঞ্চল, কৌতূহলী করে তোলে। বাংলায় চিৎকার করতে বলে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান একসময় সেই নারীকে স্পষ্টভাবে প্রথমবারের মতো ‘বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করায়। তখনই তার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে, সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেই রক্ত শহীদ আসাদের নাকি সেই বোবা বউয়ের—সিনেমা শেষে এই প্রশ্নটি দর্শকদের মনে গেঁথে যায়।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র
ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলোর মধ্যে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত রফিক উদ্দিন আহমেদ পরিচালিত হৃদয়ে একুশ, শবনম ফেরদৌসী নির্মিত ভাষা জয়িতা, রোকেয়া প্রাচীর বায়ান্ন’র মিছিল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শবনম ফেরদৌসী তাঁর প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে ২০০৮ সালে এক নারী ভাষাসৈনিককে নিদারুণ অবহেলায় মৃত্যুবরণ করতে দেখেন। তিনি আরও লক্ষ করেন, তাঁর শেষযাত্রায় খুব অল্পসংখ্যক মানুষ জমায়েত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগ জানতেনই না যে তিনি একজন ভাষাসৈনিক।

নির্মাণ না হওয়া চলচ্চিত্র
১৯৬৫ সালে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ২১শে ফেব্রুয়ারি নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দেন। তাঁর কাহিনি অনুসারে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর চিত্রনাট্যও নির্মাণ করেন। তা এফডিসিতে জমা দেওয়ার পর পুরোটা ভেস্তে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরবর্তী সময়ে জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দা চলচ্চিত্রটি নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও সেই চিত্রনাট্যটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, এফডিসি থেকেই গায়েব করে ফেলা হয় সেই চিত্রনাট্য।

গ্রন্থনা: জিনাত শারমীন