বায়ান্নর পটভূমিতে আমাদের স্বপ্নপূরণের গল্প

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্যে সিয়াম ও তিশা
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্যে সিয়াম ও তিশা

শিল্প-সংস্কৃতিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ বলা হয়। এর মধ্যে চলচ্চিত্র হচ্ছে শক্তিশালী একটি মাধ্যম। কিন্তু এই যে ফেব্রুয়ারি মাস চলছে, যে মাসের ২১ তারিখে ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল; রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঝরে পড়েছিল কয়েকটি তাজা প্রাণ। সেই ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে কোনো কাহিনিচিত্রই নির্মিত হয়নি। হ্যাঁ, ‘জীবন থেকে নেয়া’ কিংবা ‘বাঙলা’তে ভাষা-আন্দোলনের ছায়া রয়েছে কিংবা একুশের চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেখানে ভাষা-আন্দোলনের উত্তাপ ধরা পড়েনি। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবিতে অবশ্য সেই উত্তাপ ধরা পড়েছে, তবে তা ইতিহাস-আশ্রয়ী নয়। ছবিতে যে গল্প ফুটে উঠেছে, তা লেখক-চিত্রনাট্যকারের (টিটু রহমান ও তৌকীর আহমেদ) কল্পনা বা সৃষ্টি, যেখানে এ দেশের মানুষের স্বপ্ন বা অচরিতার্থ বাসনা পূরণের উপাদান রয়েছে। অবশ্য এই গল্পের সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে বাস্তবের যোগ রয়েছে। আর শেষে এর সঙ্গে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি একাকার হয়ে মিশে গেছে। 

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের এক মফস্বল শহরের থানায় এক ওসি যোগ দেয়। ঘুষখোর ও নারীলোলুপ এই পুলিশ কর্মকর্তার দাপটে শহরবাসী তো বটেই, তার সহকর্মীদের জীবনও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। থানা পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত ছিল ধাঙড় শ্রেণির যে পিতা ও কন্যা, সেই বোবা কুমারী কন্যাটি ধর্ষিত হওয়ার পর গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ওসির নির্দেশে পুরো শহরের মানুষদের বাংলায় কথা বলা নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে; থানা ও দোকানপাটের সাইনবোর্ড থেকে বাংলা হরফ মুছে গিয়ে সেখানে উর্দু স্থান পায়। থানার পুলিশ ও পথচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু শিখতে হয়। ওসিকে যথোপযুক্ত ঘুষ দিতে না পারায় মিষ্টি দোকানদার তার বেদখল হওয়া জমি (যে জমিতে মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীরা ক্লাব করেছে) ফেরত পায় না। অন্যদিকে শহরের বড় ব্যবসায়ী, স্মাগলার ও মুসলিম লীগের দাপুটে নেতা আজমতের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে তার বেআইনি কাজকর্মে মদদ দেয় ওসি।
এর জন্য সৎ সহকর্মীকে কর্তব্য কাজে বাধা এবং বকাঝকা করতেও সে দ্বিধা বোধ করে না। সে ব্রিটিশ আমল থেকে চালু অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে ‘নীল দর্পণ’ নাটকটির মঞ্চায়ন বন্ধ করে দেয়। তার নির্দেশে শহরে ধরপাকড় শুরু হয়; রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যারা রাতে চুপি চুপি দেয়াল লিখন করছিল,Ñতাদের বাধা দেয় পুলিশ। পরে অবশ্য সংস্কৃতিমান ও মুসলিম লীগের কট্টর সমর্থক আজমতের ছোট ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হয় প্রগতিশীল ও সচেতন যুবক মঞ্জু, নাসিরের ভাই। পরদিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহরে মিছিল বের করে নাসিরসহ সচেতন যুবকেরা। এই মিছিলে যোগ দেয় দীপ্তিও, যে ঠাকুরদার সঙ্গে বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করতে যাচ্ছিল। এ ছাড়া পুরো ছবিতে ফল্গুধারার মতো বয়ে যায় নাসির ও দীপ্তির প্রেম।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্যে তিশা ও সিয়াম
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্যে তিশা ও সিয়াম

উল্লেখ্য, ছবির শেষে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি মফস্বল শহরে বের হওয়া নাসিরদের মিছিলটি ফ্রিজ করে পরিচালক দেখান সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জনতার জমায়েত এবং মিছিলের স্টিল শট। তারপর ক্যামেরা স্থির হয় বর্তমান শহীদ মিনারের সামনে। নেপথ্যে বেজে ওঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুর। এভাবে বায়ান্নর কাল্পনিক গল্প ও বাস্তব ঘটনাকে একাকার করে মিশিয়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্রকার-চিত্রনাট্যকার তৌকীর আহমেদ।

একুশের প্রাক্কালে এ দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছবিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে ভালোভাবেই। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে এ দেশের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করত, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত, অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করত, তা ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবিতে স্পষ্ট। আর এ ক্ষেত্রে উর্দুভাষী ওসিই ছবিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্য
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্য

চলচ্চিত্রটির অন্যতম প্রধান চরিত্র নাসির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র ছুটিতে বাড়ি আসে। প্রতিবাদী, প্রগতিশীল ও সচেতন। সংসারে তার আপন বলতে মা আর খালাতো ভাই মঞ্জু। নাসিরের বিপ্লবী বাবা ব্রিটিশ আমলে জেলে মারা গেছেন। ওর মা সন্দেহ করেন, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। দীপ্তি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রী। বাবা লন্ডনে থাকেন। মা-হারা মেয়েটিকে অপত্য স্নেহে বড় করেছেন ঠাকুরদা। গান, অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ওর ঝোঁক রয়েছে। দীপ্তির ঠাকুরদা ডাক্তার। গরিব রোগীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি রয়েছে। তাদের তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করেন। আজমত সাহেব বড় ব্যবসায়ী। স্মাগলার। মুসলিম লীগের নেতা। হিন্দু সম্প্রদায়ের সহায়-সম্পত্তির দিকে তার লোলুপ দৃষ্টি। অল্প দামে সেই সব সম্পত্তি গ্রাস করতে প্রয়াসী তিনি। আজমতের ছোট ভাইয়ের যদিও অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক রয়েছে, তবে সে প্রগতিশীল মানুষদের পছন্দ করে না। নারীদের প্রতি দুর্বলতা থাকলেও তাদের সম্মান দিতে জানে না। মৌলভি সাহেব। সহজ-সরল এই মানুষটিকে ব্যবহার করে থানার ওসি। তার নির্দেশে তিনি উর্দু শেখান থানার পুলিশসহ সাধারণ মানুষকে। এ দেশের মানুষদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেন। পরে তার বোধোদয় হয়। তিনি একজন নতুন মানুষে পরিণত হন।
থানার নতুন ওসি উর্দুভাষী। পশ্চিম পাকিস্তানি। নারীলোলুপ ঘুষখোর বদমেজাজি অত্যাচারী এই লোকটি এই দেশের মানুষদের পছন্দ করে না। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের তো একবারেই না। ভাত-মাছ সে খায় না। তার পছন্দ রুটি ও মাংস। বাংলা ভাষাও তার পছন্দ নয়। সে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চালু করার জন্য। আর এ বিষয়ে ঘোষণা শুনে সে ভাবে, তার অনুরোধ রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। সে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দ্বিতীয় চিঠি লেখে প্রধানমন্ত্রীকে, যেন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পাখিদেরও উর্দু শেখানোর ব্যবস্থা করেন। কেননা সে লক্ষ করেছে, এ দেশের পাখিরাও বাংলায় কথা বলে। ওসির অধীন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা কিন্তু ওসির চিঠি দুটি ছিঁড়ে ফেলে। তারা ওসির নির্দেশ মানে বাধ্য হয়ে, মন থেকে নয়। তরুণ-যুবাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির প্রতিও তাদের নীরব সমর্থন রয়েছে।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ দেখে দর্শক বোর হবেন না কখনোই। কেননা গল্পটি বড় পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে নান্দনিক ও রসালভাবে। ফলে কোনো কোনো দৃশ্য বা শট দেখে দর্শক হাসিতে ফেটে পড়বে। যেমনÑ ১. নিজের ঘরে ধাঙড় শ্রেণির বোবা মেয়েটিকে ধর্ষণ করার সময় উর্দুভাষী ওসি দেয়ালে টাঙানো তার মায়ের ছবিকে ঢেকে দেয়। ২. মঞ্জুর জামাল গোটা মেশানো মালাই খেয়ে রাতে মৌলভি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর বাথরুমে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ সময়ে তিনি বাইরে বের হলে ভূতবেশী মঞ্জু ও তার দলবলের মুখোমুখি হন। মৌলভি ভয়ে কাঁপতে থাকেন। ৩. থানার প্রাঙ্গণে ওসির নির্দেশে মৌলভির কাছে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা উর্দু শিখছে, এ সময় অদূরে গাছের ওপর বউ কথা কও পাখি ডেকে ওঠে। ওসির কথায় তাকে ধরতে যায় পুলিশ সদস্যরা। ৪. বউ কথা কও পাখি খাঁচায় বন্দী অবস্থায় ওসির ঘরে অবস্থান করছে। রাতে ওসি রেডিওতে প্রচারিত উর্দু গান শোনায় পাখিকে। ৫. দিনের বেলা থানা প্রাঙ্গণে সবাই উর্দু শিখছে। তাদের মধ্যে খাঁচায় বন্দী বউ কথা কও পাখিও আছে। তার উদ্দেশে ওসি বলে উঠে, ‘বিবি বাত কারিয়ে’। পাখি ক্রমাগত বলতে থাকে ‘বউ কথা কও, বউ কথা কও।’ ৬. রাতে শব্দ শুনে ওসি ঘর থেকে বের হয়ে আসে। দুদিকে টর্চের আলো ফেলে। ওসির মোরগ চুরি করতে আসা মঞ্জু ও তার দলবল শঙ্কিত হয়ে ওঠে।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্য
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্য

ছবিতে পশু-পাখিরা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। খাঁচায় বন্দী তোতা পাখি (এখানে চলচ্চিত্রমনস্ক দর্শকদের ‘জীবন থেকে নেয়া’র কথা মনে পড়ে যেতে পারে। যদিও এই ছবিতে বিষয়টি ভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে) যেন এ দেশের মানুষেরই প্রতীক। স্টিমারে দীপ্তির হাতে খাঁচাবন্দী পাখি দেখে এবং এ বিষয়ে তার সাফাই শুনে নাসির বলে, ‘ভাবুন তো আপনাকে যদি এভাবে কেউ বন্দী করে রাখত, তাহলে আপনার কেমন লাগত!’ নাসিরের কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারে দীপ্তি এবং সে পাখিটিকে খাঁচা থেকে বের করে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেয়।...গাছের ডালে বসা বউ কথা কও পাখির কথা শুনে ওসি গুলি ছোড়ে এবং পরে তার নির্দেশে পাখিটি খাঁচায় বন্দী হয়। ওসি তাকে উর্দু শেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে কিছুতেই নিজের মুখের বুলি ভোলে না। এ পাখি বাংলাভাষী এ দেশের মানুষেরই প্রতীক।...মাংসভোজী ওসি মুরগির খোঁয়াড়ে চারটি মোরগকে স্থান দেয়, যারা মুরগিদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাবে। সে মোরগ চারটির নাম রাখে সেই সময়ের পাকিস্তানের চার শাসকদের নামে—জিন্নাহ, লিয়াকত, নাজিমুদ্দিন...। ছাগলকে আমরা বোবা প্রাণী হিসেবে জানি। এমনই এক ছাগল থানা পরিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত ধাঙড়ের বোবা মেয়ের সঙ্গিনী। এই ছাগল একপর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার বোবা মেয়েটির অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। লক্ষণীয়, মেয়েটির বাবা ঘর ভেঙে যখন মেয়েটির ঝুলন্ত লাশ আবিষ্কার করেন, তার আগে থেকে ছাগলের কান্না শোনা যায়।

লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি, এ দেশের মানুষের স্বপ্ন বা অচরিতার্থ বাসনা পূরণ হওয়ার কথা। বিষয়টির ওপর এবার আলোকপাত করা যাক। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ব্রিটিশদের মতোই আরেক শাসকগোষ্ঠীর শাসনের নাগপাশে নিষ্পেষিত হই আমরা ২২ বছর। অপমানিত-অত্যাচারিত হই; প্রতিবাদ করি, নিজেদের আত্মাহুতি দিই। কিন্তু ১৯৭১ সালের আগে কি উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানিদের শায়েস্তা করতে পেরেছি? না, পারিনি। কিন্তু ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবিতে সেটাই আমরা দেখতে পাই। দেখতে পাই উর্দুভাষী ওসি মফস্বল শহরে আসার পর থানায় যাওয়ার গাড়ি পায় না। হেঁটে হেঁটে সে থানায় আসে।...নারীলোলুপ ওসি নারীবেশী মঞ্জুর কাছে জব্দ হয়। বিষয়টি লক্ষ করে নাসির-দীপ্তিসহ অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়ে।...রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যারা রাতে চুপি চুপি দেয়ালে লিখছিল, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ওসি, গুলি করার আদেশ দেয়। কিন্তু একদিন সকালে সে আবিষ্কার করে, তার ঘরের বাইরে কারা যেন বাংলায় লিখে গেছে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘দেশলাই’ কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।...ওসির প্রিয় মোরগকে (জিন্নাহ, লিয়াকত, নাজিমুদ্দিন) চুরি করে তাদের মাংস খায় মঞ্জুরা। পরে ওসি মুরগির পালক আবিষ্কার করে।...থানার ধাঙড়টিকে মদ কেনার টাকা দিয়েছিল ওসি, সে যখন তা কিনে আনছিল তখন পথের মাঝে তাকে থামিয়ে মদের স্থলে মঞ্জুরা তাদের শরীর থেকে নির্গত তরল পদার্থ ঢেলে দেয়। ওসি মদ মনে করে সেটি পান করতে শুরু করে, তারপরই টের পায় আসল বিষয়টি।...বোবা মেয়েটি আত্মহত্যা করার পর ওর বাবা থানার ধাঙড়টি বায়ান্নর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে মাতাল অবস্থায় থানায় এসে অকথ্য ভাষায় ওসিকে গালি দেয় এবং জানায় ওর মারা যাওয়া মেয়েটিকে গর্ভবতী করেছিল ওসিই। পরদিন থানা ঘেরাও করার কথা শুনে ওসি পালায়। এ ছাড়া ওসির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন যে মৌলভি, তাঁর রূপান্তর ঘটে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নাসিররা যে মিছিল বের করে, তার শুরুতে দেখা যায় মৌলভিকে। চলচ্চিত্রকার যে অসাম্প্রদায়িক দেশের বার্তা দিয়েছেন, মৌলভির রূপান্তর সেই ইঙ্গিতই বহন করে।

ছবিটি পিরিয়ড ফিল্ম। পোশাক, আসবাব, পুলিশদের অস্ত্র, গাড়ি, রেডিও—সবকিছুতেই প্রায় সত্তর বছর আগের এ দেশ মূর্ত হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল আউটডোর শুটিং। এ ক্ষেত্রেও সতর্ক ছিলেন চলচ্চিত্রকার, ছিলেন ভীষণভাবে আন্তরিক। তারপরও একটি শট ধারণ করেছিল এ সময়ের চিহ্ন, যা ছবিটি মুক্তির আগে প্রথম ট্রেলারে ধরা পড়েছিল। কিন্তু ছবিটি যখন দেখলাম, তখন আবিষ্কার করলাম, গ্রাফিকসের কল্যাণে সেই ত্রুটি উধাও।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্য
‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির দৃশ্য

এনামুল হক সোহেলের ক্যামেরার কাজ নান্দনিক। বিশেষত টপ শটগুলো নজর কাড়ে। শেষের টপ শটটি তো অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।...অমিত দেবনাথের সম্পাদনা চিত্রগ্রহণের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়েছে। দর্শক মুগ্ধ হবে সেই ক্রশ এডিটিং দেখে, যেখানে ‘নীল দর্পণ’-এর রিহার্সালে নীলকর সাহেবরূপী আজমতের ছোট ভাইয়ের পায়ে পড়ে কাকুতি-মিনতি করে বলছে এক নারী ‘সাহেব তুমি আমার বাবা। আমাকে ছেড়ে দাও।’ অন্যদিকে থানায় নিজের ঘরে বসে বোবা মেয়েটির ইজ্জত লুণ্ঠন করছে উর্দুভাষী ওসি। এখানে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল একাকার। দুই সময়েই শাসকের চেহারা অভিন্ন। তবে দীপ্তিরূপী তিশার লিপে যে দুটি গান রয়েছে, তা চলচ্চিত্রটির গতিকে ব্যাহত করেছে। যদিও ‘তোমাকে চাই’ গানটি নেপথ্যে ব্যবহৃত হওয়ায় চলচ্চিত্রটি থমকে যায়নি। এর কথা, সুর এবং কণ্ঠ শ্রুতিমধুর।...রিপন নাথের শব্দ যথাযথ ও নান্দনিক। বিশেষত বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটির আত্মহত্যার বিষয়টি আবিষ্কারের আগে যে ছাগলের কান্না শোনা যায়, তা শুধু সাউন্ড নয়, সাউন্ড মন্টাজ। সংলাপে ত্রুটি রয়েছে। এ দেশের ধাঙড় শ্রেণির মানুষেরা সাধারণত বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলার সময় হিন্দি-উর্দু-বাংলা মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলে। আর নিজেদের মধ্যে তারা মাতৃভাষাতেই মনের ভাব প্রকাশ করে, যা এই ছবিতে দেখা যায়নি। তাই ফজলুর রহমান বাবুর কণ্ঠে ‘জ্বর’ শব্দটি কানে ধাক্কা দেয়।

অভিনয় প্রসঙ্গে শুরুতেই বলতে হয় বলিউডের যশপাল শর্মার কথা। ওসির চরিত্রে তিনি অসাধারণ অভিনয় করেছেন। এ দেশের কাউকে না নিয়ে যশপালকে নির্বাচন করে তৌকীর আহমেদ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। নইলে অভিনয় ভালো হলেও উর্দু উচ্চারণ হতো হাস্যকর। নাসিরের ভূমিকায় এ ছবিতে নতুন এক সিয়াম আহমেদকে দেখা গেছে, যার অভিনয়ের প্যাটার্ন ‘পোড়া মন ২’ এবং ‘দহন’ থেকে ভিন্ন। তিশার সঙ্গে তাঁর রসায়নও জমেছে ভালো। তিশা বরাবরের মতো এ ছবিতে ভালো করেছেন। তবে সংগত কারণেই ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এবং ‘হালদা’ ছবিকে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। ঠাকুরদার ভূমিকায় আবুল হায়াতও চমৎকার অভিনয় করেছেন। বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটির অভিনয় দেখে মনে হয়েছে ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি’। সাজু খাদেম, রওনক হাসানসহ অন্যরা চরিত্রানুগ।

‘ক্যাপ্টেন অব শিপ’ তৌকীর আহমেদের ঝুলিতে আরেকটি সাফল্যের পালক যুক্ত হলো। তাঁকে জানাচ্ছি বায়ান্নটি রক্ত পলাশের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।