তরুণদের আইকন...

>আজ বাংলাদেশের পপ কিংবদন্তি আজম খানের জন্মদিন। তাঁকে ঘিরে ১০ জানা ও অজানা তথ্য পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন জাহীদ রেজা নূর
পপসম্রাট আজম খান
পপসম্রাট আজম খান


পপসম্রাট আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরের সরকারি কোয়ার্টারে। পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। মা জোবেদা খানম গান করতেন। বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ছেলেবেলা থেকেই গানের প্রতি অনুরাগ ছিল আজমের।


পাকিস্তান আমলে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠির সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবেই গণসংগীতকে বেছে নিয়েছিলেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন, সান্ধ্য আইন ভেঙেছেন।


তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টি এ রকম: যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর তরুণদের ঢাকায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ল। আজম সিদ্ধান্ত নিলেন, মরতে হলে যুদ্ধ করেই মরবেন। মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘মা, এভাবে তো আর থাকা যায় না। আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’ মা বললেন, ‘তবে তোর আব্বাকে বলে যা।’ রাশভারী আফতাব উদ্দিন খানের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া ছিল ভয়ের ব্যাপার। তারপরও কাঁপতে কাঁপতে আজম খান গেলেন বাবার কাছে। বললেন, যুদ্ধে যেতে চান। আজম ভেবেছিলেন, এই বুঝি একটা থাপ্পড় এসে গালে পড়বে। কিন্তু আজম শুনলেন, বাবা বলছেন, ‘যুদ্ধে যাবি যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না।’



যুদ্ধের মাঠের অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন আজম খান। সেখানে গানও করেছেন অবসরে। মেলাঘরের মুক্তিযোদ্ধারা মনে রেখেছেন সেই কথা। দুর্ধর্ষ কিছু অপারেশন করেছেন তাঁরা। নরসিংদী, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আগরতলায় চলে যান আজম খান। সঙ্গে ছিলেন দুই বন্ধু শফি আর কচি। প্রশিক্ষণের পর তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুমিল্লার সালদায়। বলে দেওয়া হয়, পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করতে। ডিসেম্বরে তিনি ছিলেন ঢাকার অদূরে মাদারটেকের কাছে। এর মধ্যে বড় কয়েকটা অপারেশন করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা হতেই যে যার মতো ছুটলেন ঢাকার উদ্দেশে। সে এক অভূতপূর্ব আনন্দ!


স্বাধীনতার পর যুবসমাজের মনে হতাশা এসেছিল। আজম খান দেশি–বিদেশি গান শুনতেন। প্রিয় ছিল শ্যাডোজ, রোলিং স্টোন, বিটলস। ডিআইটিতে ছিল টেলিভিশন ভবন। ২৬ জন মিলে সেখানে একটি অনুষ্ঠান করলেন। খুব খারাপ হলো সে অনুষ্ঠান। আজম বললেন, এরপর আরেকটা অনুষ্ঠান ঠিক করতে। তারিখ ঠিক হলে বললেন, আমি দেখছি কী করা যায়। পাড়ার রেস্তোরাঁয় শিঙাড়া খেতে খেতে অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকল। তখন নীলু আর মনসুর গিটার আর সাদেক ড্রামে। ভোকাল আজম খান। তাঁরা এবার গাইলেন ‘এত সুন্দর দুনিয়ায়’, আর ‘চার কলেমা সাক্ষী দেবে’। খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠল গান দুটি। শুরু হলো পথ চলা।


দু–এক দিনের মধ্যেই মৌচাক মার্কেটের সামনে দেখা হলো নটরডেম কলেজের ছাত্র হারুণের সঙ্গে। তিনি খুব প্রশংসা করে বললেন, ইডেন কলেজ আর নটরডেম কলেজ যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠান করছে, সেখানে গাইবেন কি না। গান করলেন তাঁরা। মোহিত করলেন শিক্ষার্থীদের।


তখন হাতে গোনা চারটি গান তাঁদের। ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল ওয়াপদা মিলনায়তনে এই গানগুলোই করলেন। উল্লসিত দর্শকেরা বলে যাচ্ছেন, ওয়ান মোর ওয়ান মোর। কিন্তু সম্বল যাঁদের চারটিমাত্র গান, তাঁরা এই আহ্বানে সাড়া দেবেন কী করে? এরপর মহল্লায় মহল্লায়, টিএসসিতে আয়োজিত হতে থাকল আজম খানের গান। তখনই তৈরি করলেন ব্যান্ড, ‘উচ্চারণ’ নামে। অভিসার, মধুমিতা, জোনাকিতে হলো গান।


ঢাকার বাইরে প্রথম গান করতে গেলেন কুমিল্লায়। ২২ জনের দল নিয়ে। গেলেন প্লেনে করে। সে সময় প্লেনের টিকিটের দাম ছিল ২০ টাকা। প্রথমে একটু অস্বস্তিতে ছিলেন। অভিভাবকেরাও আসবেন গান শুনতে। তাঁরা কীভাবে পপ গানকে নেবেন, তা নিয়ে ছিল দুশ্চিন্তা। তবে খুবই ভালো প্রতিক্রিয়া পেলেন। এরপর চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ দেশের অনেক জেলাতেই গান করতে গেলেন।


তরুণদের মধ্যে আজম খান ক্রেজ তৈরি হলো। লম্বা চুল, দাড়ি–গোঁফ, বেলবটম প্যান্ট নিয়ে আজম খান হয়ে উঠলেন তরুণদের আইকন।

১০
২০১১ সালের ৫ জুন তিনি মারা যান।