৩৫ বছর পর...

মীরার মহড়ায় নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীদের সঙ্গে  কাজল ইব্রাহীম ও সুকল্যাণ ভট্টাচার্য (মাঝে)
মীরার মহড়ায় নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীদের সঙ্গে কাজল ইব্রাহীম ও সুকল্যাণ ভট্টাচার্য (মাঝে)

চমকে দেওয়া খবরটা আগেই দেওয়া যাক। নৃত্যাঞ্চল নিয়ে আসছে নতুন নৃত্যনাট্য মীরা। তার চেয়ে বড় খবর, এই নৃত্যনাট্য দিয়ে ফের মঞ্চে আসছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী কাজল ইব্রাহীম। ৩৫ বছর আগে পরিবার ও নানা ব্যস্ততায় নাচের মঞ্চ থেকে দূরে সরে যান তিনি। মীরা নৃত্যনাট্যের মূল আকর্ষণ তাই এই অগ্রজ নৃত্যশিল্পীকে ঘিরেই।

রোববার বিকেল। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যকলা ভবনের নিচতলায় নাচের মহড়াকক্ষে নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীরা উপস্থিত। চলছে মহড়া। কাজল ইব্রাহীমের সঙ্গে জনা পঞ্চাশেক নৃত্যশিল্পী। নাচের মুদ্রায় উঠে আসছে একের পর এক দৃশ্য। দুজন কাজল ইব্রাহীমকে নিচের দিকে নোয়ানোর চেষ্টা করছেন। দেখলে মনে হয়, যেন কেউ তাঁকে পানিতে চুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। সামনেই তরুণ নৃত্যশিল্পীরা দেহভঙ্গিমা দিয়ে তৈরি করছেন পানির ঢেউ। এভাবে এগিয়ে চলে একের পর এক দৃশ্য। মাঝেমধ্যেই বাদ সাধেন নৃত্যনাট্যটির পরিচালক ভারতের নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। দেখিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন ভঙ্গিমা। শিল্পীরা তা শুধরে নিচ্ছেন ঠিকঠাক। মহড়ার পাশেই বসা নৃত্যশিল্পের পরিচিত জুটি—শামীম আরা নীপা ও শিবলী মহম্মদ। প্রযোজনা নিয়ে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।

শামীম আরা নীপা বলেন, ‘প্রতিটি প্রযোজনাই একটি নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা নিয়ে করা হয়। এই প্রযোজনার লক্ষ্যটা একটু অন্য ধরনের। আমরা দেখেছি যে নাচের কোনো ডকুমেন্টেশন নেই। আমরা শুধু কিংবদন্তি শিল্পীদের কথা শুনি। তাঁদের একটা নাচও আমাদের কাছে রেকর্ড নেই, যা দেখে আমরা তাঁদের নাচ বুঝতে পারি। হ্যাঁ, বইতে পড়েছি। কিন্তু তা দিয়ে কতটুকু বোঝা যায়। এই প্রযোজনা দিয়ে আমরা আসলে তেমন একটি ডকুমেন্টেশন করছি। আমাদের অগ্রজ শিল্পী কাজল ইব্রাহীম। তিনি অসম্ভব ভালো নাচ করেন। এই প্রযোজনার মূল উদ্দেশ্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা ডকুমেন্টশন তৈরি করা। যাতে অগ্রজদের নাচ তারা দেখতে পারে।’

এই কথার সঙ্গে সুর মেলালেন শিবলী মহম্মদও। তিনি বলেন, ‘এই শিল্পীরা কিন্তু আমাদের পথিকৃৎ। জি এ মান্নান, গওহর জামিল, হাসান ইমাম, আমির হোসেন বাবুদের নাচ দেখে যেমন অনুপ্রাণিত হই, তেমনি কাজল ইব্রাহীম, লুবনা মরিয়ম, জিনাত বরকতুল্লাহ—এঁদের নাচ দেখেও অনুপ্রাণিত হয়েছি আমরা। তাই তাঁদের প্রতি এটা আমাদের একটি দায়িত্ব বলা যায়।’

মীরা নৃত্যনাট্যে শিবলী, শামীম আরা নীপা
মীরা নৃত্যনাট্যে শিবলী, শামীম আরা নীপা

কাজল ইব্রাহীমের বয়স এখন ৬৬ বছর। কিন্তু মহড়ায় তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে যেভাবে নাচলেন, তাতে নৃত্যশিল্পী হিসেবে এখনো তিনি তরুণ–সবুজ। নাচের মুদ্রায় বয়সের ছাপ যেন কোথায় মিলিয়ে যায়। কাজল ইব্রাহীমকে কেন্দ্র করেই যেহেতু নৃত্যনাট্য, তাই তাঁকে মানায় এমন একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করেই নাচের গল্পটি সাজানো হয়েছে।

গল্পের কেন্দ্রে ঐতিহাসিক চরিত্র মীরা বাই। কৃষ্ণের প্রেমে যিনি মরিয়া ছিলেন। সঙ্গে রাখতেন সব সময় কৃষ্ণমূর্তি। এই প্রেমে তাঁর ভেতরে উৎসারিত হয় সুরের। কৃষ্ণের প্রেমে গান ও কবিতা রচনায় বিরক্ত হন মীরার স্বামী। মীরার ওপর চলতে থাকে নির্যাতন। এদিকে মীরার সুরের খোঁজ পান সম্রাট আকবর। একসময় তিনি ছদ্মবেশে শুনতে যান মীরার সুর। মোহিত হয়ে নিজের মালা উপহার দিয়ে ফেলেন। তাতেই মীরার স্বামী বুঝে যান এখানে এসেছিলেন সম্রাট আকবর। নির্যাতন বাড়তে থাকে মীরার ওপর। কয়েকবার মীরাকে হত্যা করারও প্রচেষ্টা করা হয়। কিন্তু কৃষ্ণের বরে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এরপর মীরা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সুর সাধনায় চলে যান বনে। পরবর্তীকালে মনে করা হয়, মীরা কৃষ্ণপ্রেমে সেখান থেকে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিয়ে যান।

এই মীরার চরিত্রে ৩৫ বছর পর আবারও মঞ্চে আসছেন কাজল ইব্রাহীম। উত্তরসূরিদের সঙ্গে তিনি এখন মঞ্চে। কেমন লাগছে? কাজল ইব্রাহীম বলেন, ‘আমি মুগ্ধ এবং ভীষণ গর্বিত। এই পরিচালকের কোরিওগ্রাফিতেও আমি মুগ্ধ। আমার ছেলের বয়স এখন ৩৫ বছর। ওর যখন ছয় মাস বয়স, তখন শেষ আমি মঞ্চে উঠি। পরিবারের ব্যস্ততার কারণে আর মঞ্চে উঠতে পারিনি। কিন্তু নীপা ও শিবলী আমার কাছে এসেছে। বলত, “আপা একটা কম্পোজিশন দেখিয়ে দাও”। এভাবে নাচের মধ্যেই ছিলাম বলা চলে।’

নৃত্যনাট্যটি পরিচালনা করেছেন সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। এর আগে বাঁদী–বান্দার রূপকথা নৃত্যনাট্য পরিচালনা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রযোজনা নিয়ে তিনি বললেন, ‘কাজল ইব্রাহীম আমাদের বন্ধু। তিনি কলকাতায় আমাকে তাঁর নৃত্য জীবনের কাহিনি বলছিলেন। তখন এক রকম নাচের ভাষা ছিল। এখন এক রকম হচ্ছে। আমার প্রায় প্রযোজনাই তিনি দেখেছেন। আমি তাঁকে বললাম, আপনিই কেন করবেন না। ফিরে আসুন। ৩৬ বছর আমাদের কাছে তো ছয় দিন। নৃত্যশিল্পীদের বয়স হয় না। আর শিল্পেরও মৃত্যু হয় না। চলুন কাজ শুরু করি।’

এই নৃত্যনাট্যে দেখা যাবে পরিচালক সুকল্যাণ ভট্টাচার্যকেও। কৃষ্ণের রূপে তিনি দেখা দেবেন। আর রাধার চরিত্রে শামীম আরা নীপা ও আকবরের চরিত্রে দেখা যাবে শিবলী মহম্মদকে। নৃত্যনাট্যটির সংগীতায়োজন করেছেন স্নেহাশীষ মজুমদার। ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় দেখা যাবে এটি।