গানের মঞ্চে আর্টসেলের পুনর্মিলনী

দীর্ঘদিন পর এক মঞ্চে আর্টসেলের সদস্যরা। ছবি: চৌধুরী সিফাতের ফেসবুক থেকে
দীর্ঘদিন পর এক মঞ্চে আর্টসেলের সদস্যরা। ছবি: চৌধুরী সিফাতের ফেসবুক থেকে

‘ভাই, আমার চোখে পানি চলে আসছে।’
আর্মি স্টেডিয়াম তখন জনসমুদ্র। জয় বাংলা কনসার্টে মাত্রই আর্টসেলের সঙ্গে ‘দুঃখ বিলাস’ শেষ করেছে হাজার হাজার মানুষ। তার মধ্যেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সজিবুজ্জামানের গলা ফাটানো কথাটা শুনে চমকে তাকালাম। ‘আর্টসেলের গান শুনে বড় হয়েছি ভাই। মেম্বারদের মধ্যে দূরত্বটা খুব কষ্ট দিত। আজকে সবাইকে এক মঞ্চে দেখে এত ভালো লাগছে! দুঃখ বিলাস গানটা গাইতে গাইতে ইমোশনাল হয়ে পড়লাম।’
প্রিয় ব্যান্ডের প্রতি এমন আবেগ থেকেই সংগীতপ্রেমীরা জড়ো হয়েছিলেন জয় বাংলা কনসার্টে। শুধু জয় বাংলা কনসার্টের মঞ্চে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে উড়ে এসেছেন আর্টসেলের দুই সদস্য—সেজান ও সাজু। ভোকাল লিংকনের সঙ্গে মিলে তাঁরা পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নতুন গিটারিস্ট কাজী ফয়সাল আহমেদকে। অনেক বছর পর পুরো লাইনআপ নিয়ে ভক্তদের উন্মাদনায় ভাসিয়েছে আর্টসেল। দীর্ঘদিন ধরে ব্যান্ডটির নতুন গান নিয়ে সংশয়ে ছিল আর্টসেলপ্রেমীরা। তাঁদের জন্য চমক ছিল নতুন গান ‘সংশয়’-এর ঘোষণা।
বরাবরের মতোই সাতই মার্চের ভাষণের চেতনায় দেশাত্মবোধক গান গেয়েছে ব্যান্ডগুলো। বে অব বেঙ্গল, শূন্য, লালন, আর্বোভাইরাস, ক্রিপটিক ফেইট, নেমেসিস, চিরকুট এবং আর্টসেলের গানে মাতোয়ারা ভক্ত-দর্শক। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে গানগুলো উদ্দীপ্ত করেছিল মুক্তিকামী মানুষকে, এত বছর পরও কমেনি সেই গানগুলোর আবেদন। তরুণ প্রজন্ম এখনো কণ্ঠ মেলায় ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, কিংবা ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’ গানের সুরে। জাতীয় পতাকা উঁচিয়ে, লাল–সবুজ টি-শার্ট, ব্যান্ডেনা পরে হাজার হাজার মানুষ এসেছিল তারুণ্যের এই কনসার্টে। সন্ধ্যার আগেই কানায় কানায় ভরে উঠেছিল রাজধানী আর্মি স্টেডিয়াম। গ্যালারি তো বটেই, মাঠও ছিল একবারে পরিপূর্ণ। বিশাল মঞ্চ থেকে আসা আলোতে যত দূর চোখ যাচ্ছিল, শুধু উল্লসিত মানুষের মুখ। একটু পরপর দূর আকাশে ছোটা আতশবাজি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল মানুষের উচ্ছ্বাস। বিদেশি অতিথিরাও দারুণ উপভোগ করছিলেন ইয়াং বাংলার এ আয়োজন। রাশিয়া থেকে আসা দর্শকদের একটা দল সঙ্গীর কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে পুরো স্টেডিয়াম। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা নেচে নেচে রাশিয়া আর বাংলাদেশের বিশাল পতাকা নেড়েছে গানের তালে তালে। আকাশে উড়তে থাকা ড্রোনের চিত্র দেখে মনে হচ্ছিল গানের তালে নাচছে কোনো সমুদ্রের ঢেউ! শূন্যর ‘গোধূলির ওপারে’, আর্বোভাইরাসের ‘হারিয়ে যাও’ কিংবা ক্রিপটিক ফেইটের ‘প্রতিবাদ’ গানের সময় মোবাইলের আলো জ্বেলে হাত নাড়ছিলেন ভক্তরা। মনে হচ্ছিল লাখ লাখ জোনাকি এসে জড়ো হয়েছে স্টেডিয়ামে। এ আয়োজনের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছে ব্লুজ কমিউনিকেশন।
এমন অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যে ভক্তরা দিশেহারা! একজন তো দিশেহারা হয়ে মঞ্চেই উঠে গেলেন। মঞ্চে তখন নেমেসিস। হঠাৎ সেই যুবক নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ এড়িয়ে দৌড়ে উঠে জড়িয়ে ধরলেন নেমেসিসের ভোকাল জোহাদকে। গান গাইতে থাকা জোহাদ চমকে উঠলেও ভক্তকে নিরাশ করেননি, নিরাপত্তারক্ষীরা সামলে নেওয়ার আগে হেসে পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন সেই ‘পাগল’ ভক্তের।
নেমেসিসের গানে চমক ছিল আরও। হঠাৎই পাওয়ার সার্জের ভোকাল জামশেদকে মঞ্চে ডেকে নেন জোহাদ। দুজন মিলে গাইলেন ‘অবচেতন’। একটু পর ‘মা গো ভাবনা কেন’ গানে চমক হিসেবে তাঁদের সঙ্গে গলা মেলান ক্রিপটিক ফেইটের শাকিব চৌধুরী।
নেমেসিসের ঠিক আগেই মঞ্চ মাতিয়ে যায় ক্রিপটিক ফেইট। চমক ছিল তাদের পরিবেশনায়ও। প্রথমবারের মতো ক্রিপটিক ফেইটের সঙ্গে ঢোল বাজিয়েছেন নজরুল। আপেল মাহমুদের কথা ও সুরে ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ গানে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল নজরুলের ঢোল।
চিরকুট শুরু করেছিল জাতীয় সংগীত দিয়ে। ইমনের গিটারের সুরে পুরো স্টেডিয়াম একসঙ্গে গেয়ে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সে এক অদ্ভুত শিহরণ–জাগানিয়া অনুভূতি!
চিরকুটের পরই শেষ ব্যান্ড হিসেবে মঞ্চে উঠেছিল আর্টসেল। শেষ গান পর্যন্ত কানায় কানায় ভরা ছিল স্টেডিয়াম। গানের খিদে কি এত দ্রুত মেটে? তবু বাড়ি ফিরতে হয়। অসংখ্য তরুণ বাস, পিক-আপে করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাইছিল কনসার্টে শোনা গানগুলোই।