ইট বিক্রেতা ছেলেটি সিনেমার নায়ক!

এ কে আজাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
এ কে আজাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

স্কুল ও কলেজের পাট শেষ করে বগুড়ার তরুণ এ কে আজাদ ঢাকায় আসেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হন। থাকার জায়গার অভাব, তাই মামার সঙ্গে গার্মেন্টসের ছোট্ট ঘরে থেকেছেন। নিজের আয়ে চলার জন্য ইট বিক্রি করার কাজ বেছে নেন। এই ইট বিক্রি করতে গিয়ে পান্থপথ থেকে শ্যামলী পর্যন্ত হেঁটে গেছেন। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেছেন। এখন তিনি একজন অভিনয়শিল্পী। ২০১৪ সালে চ্যানেল আই আয়োজিত ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম দ্য আল্টিমেট ম্যান’ প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন। এরপর তাঁর অভিনয়ে পথচলার শুরু। প্রথম নাটকে আজাদ সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন সুবর্ণা মুস্তাফা আর আবুল হায়াতকে। নাটকের পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞাপনচিত্র ও গানের ভিডিওতে মডেল হয়েছেন। সম্প্রতি কাছাকাছি সময়ে দুটি সিনেমায় তাঁকে নায়ক হিসেবে চূড়ান্ত করেছেন পরিচালক ও প্রযোজক।

গত সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলো কার্যালয়ে কথা হয় নতুন প্রজন্মের অভিনয়শিল্পী আজাদের সঙ্গে। অভিনয়ের স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে বললেন, ‘অভিনয় করব, মানুষের ভালোবাসা পাব, মানুষ আমাকে চিনবে—ছোটবেলা থেকে মনের মধ্যে এমন স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল স্কুলজীবনে। ক্লাস ফোরে যখন পড়ি, তখন মঞ্চনাটকে অভিনয় করি। আমাদের একজন লজিং মাস্টার ছিলেন, তিনি ছিলেন খুব সংস্কৃতিমনা। তিনি আমাদের এলাকার অনেককে একত্র করে মঞ্চনাটক করতেন। আমার ভালো লাগা আরও বাড়তে থাকে।’

আজাদের পরিবারও সংস্কৃতিমনা। তিন ভাই ও এক বোনের সংসার। মা মর্জিনা বেগম সন্তানদের নিয়ে সিনেমা দেখতেন। মায়ের কারণে আজাদের মাথায়ও সিনেমা পোকা ঢোকে। বললেন, ‘তাঁর পরিবারের সবাই চিত্রনায়ক সালমান শাহর ভীষণ ভক্ত। বগুড়ার উত্তরা প্রেক্ষাগৃহে মায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা সিনেমা ছিল ‘মাটির মানুষ’। পরিবারের সবাই মিলে সালমান শাহর ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবিটি দেখতে যাওয়ার পথে রাস্তায় বোনকে হারিয়ে ফেলেন আজাদ। ছবি দেখা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দেখেন বোন বাসায় চলে এসেছে। পরদিন সবাই মিলে আবার ছবিটি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যান।

বগুড়ার শিববাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছেন আজাদ। এরপর ফাপোড় হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও পুলিশ লাইনস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১২ সালে ঢাকায় এসে দুই বছরের হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। শুরু হয় আজাদের সংগ্রামের জীবন।

চ্যানেল আই আয়োজিত ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম দ্য আল্টিমেট ম্যান’ প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন হন এ কে আজাদ
চ্যানেল আই আয়োজিত ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম দ্য আল্টিমেট ম্যান’ প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন হন এ কে আজাদ

সেদিনের কথা মনে করতেই নতুন প্রজন্মের এই মডেল ও অভিনয়শিল্পী বলেন, ‘ঢাকায় এসে মামার সঙ্গে থাকা শুরু করি। হোটেল ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হই। আমার থিওরির ক্লাস হতো ওয়েস্টিন হোটেলে। পড়ার ফাঁকে পত্রিকায় পার্টটাইম চাকরির খোঁজ করতাম। পেপার কাটিং সংগ্রহ করেছি। একটি বিল্ডার্স কোম্পানির খোঁজ পাই। পান্থপথে অফিস। গেলাম দেখা করতে। প্রতিষ্ঠানটি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের যাবতীয় কাঁচামাল বিক্রি করে। এ কাজে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার তেজগাঁও আর গুলশান এলাকা দেওয়া হয়। সেদিন আমাকে ইট বিক্রির জন্য দুটি ইটের নমুনা ধরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, শ্যামলীতে গিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। গ্রাহক আমার কথা শুনে দুই লাখ ইটের অর্ডার দেন। পরদিন অফিস গিয়ে জানতে পারি, আমাকে কমিশনের যে টাকা দেওয়ার কথা, তা পাব না। কারণ, ওই এলাকা নাকি অন্যজনের। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কিছু দেবেন। কিন্তু আমি সেভাবে সুবিধা নেওয়ার মানুষ না। তাই আর ওই অফিসে যাইনি।’

অভিনয়শিল্পী আজাদ নাচ শিখেছেন, যুক্ত ছিলেন ব্যান্ডের সঙ্গে। ২০০৮ সালে ‘মিশন এক্সপ্রেস’ নামের এই গানের দলের কি-বোর্ডিস্ট ছিলেন তিনি। দুই বছর যুক্ত থেকেছেন। ২০১৪ সালে ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম দ্য আল্টিমেট ম্যান’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবার চোখে পড়েন। তার দুই বছর আগে এই প্রতিযোগিতায় আরও একবার অংশ নিয়েছিলেন। তখন সেভাবে এগোতে পারেননি। তবে দমে যাননি। নিজেকে পুরোপুরি তৈরি করে দুই বছর পর আবার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজের স্বপ্নপূরণের পথে আনুষ্ঠানিকভাবে পা বাড়ান।

আজাদ বলেন, ‘আমি তখন ওয়েস্টিন হোটেলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি করি। কেন জানি সবাই আমাকে পছন্দ করতেন। একদিন হোটেলের একটি অনুষ্ঠানে নাচার পর সবাই আমাকে আরও বেশি আপন করে নেন। বলতে পারেন, জনপ্রিয় হয়ে উঠি। এরপর ওয়েস্টিন হোটেলের কর্তৃপক্ষ আমাকে চ্যানেল আইয়ের এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়। এরপর অভিনয়ের দরজা সহজে খুলে যায়।’

চলচ্চিত্রের দুই নায়িকা রানি আহাদ আর নিশাত নাওয়ার সালওয়ার সঙ্গে এ কে আজাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
চলচ্চিত্রের দুই নায়িকা রানি আহাদ আর নিশাত নাওয়ার সালওয়ার সঙ্গে এ কে আজাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

পাঁচ বছরে আজাদ অসংখ্য নাটক আর টেলিছবিতে অভিনয় করেছেন। তার হিসেবে সব মিলিয়ে ৪০টি। ছয়টি ধারাবাহিক নাটকেও অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের বাইরে ২০টি গানের ভিডিওতে কাজ করা হয়েছে। প্রিয় তিনটি গানের ভিডিওর কথা উল্লেখ করলেন তিনি—অটামনাল মুনের ‘তুই আমার মন ভালো রে’, লাকী আখান্দের ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ ও ইমরানের ‘ভাসি ডুবি’।

আজাদ এখন চলচ্চিত্রের নায়ক হয়ে আসছেন। পরপর দুই সপ্তাহে দুটি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। প্রথমটি রাজু চৌধুরীর ‘রাজকন্যা’ আর দ্বিতীয়টি রাইসুল রনির ‘ফেরারি প্রেম’। দুটি সিনেমায় তাঁর বিপরীতে নায়িকা রানি আহাদ ও নিশাত নাওয়ার সালওয়া। রানি আহাদ সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘যদি একদিন’ সিনেমায় অভিনয় করে আলোচিত হয়েছেন। এই ছবিতে তিনি তাহসান ও তাসকিনের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। অন্যদিকে, নিশাত নাওয়ার ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার গত আসরের প্রথম রানারআপ।

আজাদ বলেন, ‘এখন আমার সব স্বপ্ন চলচ্চিত্রকে ঘিরে। তাই নাটকে অভিনয় করছি না। পুরো মনোযোগ দিচ্ছি চলচ্চিত্রে।’