কাচের পৃথিবীতে কয়েকজনা

মুক্তি নাটকের দৃশ্য
মুক্তি নাটকের দৃশ্য

এপার বাংলা ওপার বাংলার সাংস্কৃতিক মেলামেশাতে হাল আমলে যে বসন্ত এসেছে, তার পালে হাওয়া তুলে থিয়েটারের মুক্তি নাটকের দুটি মঞ্চায়ন হলো পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস মাথায় রেখে ‘নারীর মঞ্চ’ নামে যে বার্ষিক আয়োজন করে নান্দীপট, তার চতুর্থ সন্ধ্যায় ১১ মার্চ দক্ষিণ কলকাতার তপন থিয়েটারে দেখা গেল মুক্তি। পরদিনই সুখচর পঞ্চম রেপার্টরি থিয়েটারের ‘দর্শকের দরবারে’ নাট্যমেলায় এই প্রযোজনার ৯১তম মঞ্চায়ন হলো কলকাতার উপকণ্ঠে সোদপুরের লোকসংস্কৃতি ভবনে। দুই সন্ধ্যার অভিজ্ঞতায় ভাবনার খোরাক জুটল অঢেল।

মার্কিন নাট্যকার লি ব্লেসিংয়ের যে নাটকের আধার সেই ইনডিপেনডেন্স-এর বয়স চৌত্রিশ পেরিয়েছে। মিজারুল কায়েসের বাংলা রূপান্তরে ভর করে ত্রপা মজুমদার যে প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন, তারও বয়স পনেরো ছুঁল। পুরোনো হওয়া দূরে থাক, আরও নতুন করে পাওয়া যাচ্ছে মুক্তিকে। একদিকে নগরায়ণ অন্যদিকে আধুনিকতা—এই জোড়া ধাক্কায় ক্রমশ একা আরও একা হয়ে পড়া মানুষের কথা এই দুনিয়া ঘুরেফিরে শুনতে চাইছে। নারীর মর্যাদাবোধ আর ক্ষমতায়নের আড়ালে থাকা কোনো ঘুণপোকা তাকে সামাজিকভাবে আরও কোণঠাসা করে দিচ্ছে কি না, এ প্রশ্নও উঠছে ইতিউতি। এই আবহাওয়াতে এক মা আর তার তিন মেয়েকে মাঝখানে রেখে নাগরিক নিঃসঙ্গতার নানান রকমের চোরকাঁটাকে টেনে টেনে বের করেছে মুক্তি। এর চলন একটু পশ্চিমা ধাঁচের হলেও পুবের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে দেড় ঘণ্টার এই নাটক।

দেখতে–শুনতে সাবেক ঘরানার ড্রয়িংরুম ড্রামা মুক্তি। নির্মেদ ও নিটোল। সূক্ষ্ম তারের মনস্তাত্ত্বিক অভিনয়ের জন্য আদর্শ। দেখতে দেখতে আন্তন চেখভের থ্রি সিস্টার্স মনে পড়তে পারে। মনে পড়তে পারে মহেশ এলকুঞ্চওয়ারের সোনাটা। এর নারীতান্ত্রিক এবং প্রায় পুরুষ ভূমিকাবর্জিত দমচাপা গুমরে মরা আবহাওয়াতে ফ্রেডরিক গার্থিয়া লোরকার ‘দ্য হাউস অব বার্নার্ডা আলবাও’ ঘাপটি মেরে আছে। মার্কিন চালের মূল নাটকের খানিক অদলবদল করে যে আদলটি গড়েছেন মিজারুল কায়েস, তাতে গুলশান-বনানী-উত্তরার আঁচ পড়েছে। দোতলা একটি বাড়ি। তাতে মায়ের (ফেরদৌসী মজুমদার) সঙ্গে থাকেন দুই মেয়ে—দামিনী (তানজুম আরা পল্লী) আর সোহিনী (তানভীন সুইটি)। বাবা তাঁদের ছেড়ে গেছেন। অধ্যাপনার দোহাই দিয়ে তাঁদের ছেড়ে গেছেন বাড়ির বড় মেয়ে রজনী (তামান্না ইসলাম)। ছেড়ে যাবার চার বছর বাদে এই রজনীর ঘরে ফেরা দিয়ে নাটকের শুরু। কেন ফিরেছেন রজনী? কারণ, মায়ের তবিয়ত জুতের নয়। দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য—দুয়েরই অবস্থা ভঙ্গুর। ছোট বোন সোহিনী আর্ট কলেজে যান। মূর্তি গড়ায় হাত পাকান। যৌবন ধর্মের দাবি মেটাতে তিনি অকুণ্ঠ। লেখাপড়ার পাট চুকোনোর ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই সোহিনী যে এ বাড়ি ছেড়ে যাবেন, এ ব্যাপারে মায়ের মনে কোনো সংশয় নেই। এদিকে যে দামিনীর ওপর মায়ের অগাধ আস্থা, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। অনাগত সন্তানটিকে নিয়ে সবার আগ্রহ থাকলেও অচিরেই আলাদা ঘর বাঁধতে চাইছেন তিনি। বাদ সাধছেন মা। হুলুস্থুল বাধাচ্ছেন। ওদিকে দামিনীর প্রেমিকটিও নড়বড়ে। এভাবেই এগোয় নাটক। চড়তে থাকে পারদ। ফিমেল বন্ডিঙের একটি খোলামেলা চেহারা ফুটে বেরোয়। মধ্যান্তর আসে। ঘরে বাইরের টানাপোড়েন তীব্র থেকে তীব্রতর হয় দ্বিতীয়ার্ধে। মিহি সুতোয় বোনা জালের মতো আচ্ছন্ন করে দর্শকদের স্নায়ুতন্ত্রীকে। আচমকা সব আলো পড়তে থাকে ব্যক্তিজীবনের আবছায়াতে। শেষমেশ তিন কন্যা যে যার মতো করে মুক্তির খোঁজে বেরিয়ে যান। কতক নিজের মুদ্রাদোষে কতক নিয়তি নির্ধারণে ফাঁকা বাড়িতে একা পড়ে থাকেন মা। বারেবারে সাজিয়ে তোলা ভরে ওঠা ছড়িয়ে ফেলা ফলের ঝুড়ি হয়ে ওঠে ভঙ্গুর এই পরিবারের প্রতীক। মায়ের চরিত্রাভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের পোড়খাওয়া গলায় হাহাকার ‘সবাই এই বাড়িটাকে ছাড়তে চায়...মার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চায়’ গলার ভেতর কান্না হয়ে গুমরোতে থাকে।

নির্দেশক ত্রপা মজুমদার জানতেন যে এমন প্রযোজনা দাঁড়িয়ে থাকে অভিনয়ের ওপর। দরকার উঁচু দরের মেথড অ্যাকটিং। মনসুর আহমেদের মঞ্চসজ্জায় এমনিতে ভাঙচুরের ইশারা নেই। আছে একটি খোলামেলা বৈঠকখানার মেজাজ। তাতে ইচ্ছেমতো আলগা হতে পারেন চার কুশীলব। তা ফুরসত পান না। নাসিরুল হক খোকনের নকশা করা আলোর উসকানিতে ত্রপা প্রতিনিয়ত এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নাট্যমুহূর্ত বুনে চলেন যে এক লহমার জন্য জিরোবার উপায় থাকে না। পনেরো বছর ধরে একই অভিনেত্রী নিয়ে মুক্তি চলছে বলেই হয়তো কুশীলবদের বোঝাপড়ায় এমন পাক ধরেছে যে কথার পিঠে কথা চাপছে, এটাসেটা নিয়ে খুনসুটি হচ্ছে, কাড়াকাড়ি চলছে, বেফাঁস বলে জিব কাটা হচ্ছে, বলতে না চেয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা হচ্ছে, অথচ কোথাও তেলেজলে হচ্ছে না। তিন বোনের মধ্যে চাপা আক্রোশ ঝলসে উঠছে মাঝেসাঝে। মায়ের আপাতস্নিগ্ধ প্রতিমার আড়ালে খেলে যাচ্ছে ঈর্ষা এমনকি জিঘাংসা। মগ্ন হচ্ছেন দর্শক। কারও দিকে ঝোল টানা হচ্ছে না বলে অস্বস্তি হচ্ছে। এই অস্বস্তি জিইয়ে রেখেই আলো নিভছে। ডাগর চোখের তানভীন সুইটি ছোট বোনের চরিত্রের অকারণে চঞ্চল সত্তাকে চিনেছেন ঠিক। সংবেদনশীল মেজ বোনের ভেতরকার বিষাদসিন্ধুকে চিনিয়েছেন তানজুম আরা পল্লী। মার্জিত ভারসাম্য বজায় রেখে সংযত অভিনয় করেছেন বড় বোন তামান্না ইসলাম। আর ফেরদৌসী মজুমদার? একটুও দেখানেপনা নেই। উত্তেজনার মুহূর্তেও কীভাবে গুটিয়ে থাকতে হয় তাঁর কাছে তা জলভাত। আবার যখন গুটি ছেড়ে বেরোতে হয়, ফুলকি ছড়াতে হয় মিলনায়তনে, তখনো নিচু চাবির চরিত্রায়ণের মাত্রার কোনো হেরফের করেন না তিনি। তাঁদের পরিমিতিবোধের এই অনুশীলন মুক্তির জিয়নকাঠি।

দুটি অন্য কথা। মিজারুল কায়েস এটিকে ‘ভাবানুবাদ’ বলেছেন। বেশ কথা। তবে ইংরেজি কথার আক্ষরিক তরজমায় মাঝেমধ্যে আড়ষ্ট হয়েছে অনুভব। ‘পজিটিভ’ আর ‘ইতিবাচক’-এর ঠোক্কর না হয় মেনে নেওয়া গেল। তাই বলে ‘উত্তরোত্তর শিশুতোষবাদ’কে চিনতে ভিরমি খাবার জো হয়েছে আমাদের। আর একটু হতাশ করেছে আবহসংগীত। সুর মূলত বেজেছে দৃশ্যান্তরের ফাঁক ভরাতে। সব যে চেনা এমন নয়। কিছু চেনা। যেমন ১৯৭০-এর দশকে জন ডেনভারের গলায় রেকর্ড করা ‘কান্ট্রি রোডস’। কেন? যে নাটকের ধ্রুপদ হিসেবে ফিরে ফিরে এসেছে বিদ্যাপতির ‘এ ভরা বাদর মাহ বাদর শূন্য মন্দির মোর’, ছুঁতে পেরেছে এই উপমহাদেশের অন্তর্লীন বিষণ্নতাকে, সে নাটকে এমন কোড মিক্সিং কাজে দেয় না।

থিয়েটারের এ প্রযোজনার যখন আবির্ভাব, তখনো ডিজিটাল রেভল্যুশনের বান ডাকেনি। একান্নবর্তীর রেশ তখনো ধরা ছিল গ্রাম-নগরের যাতায়াতে। নাগরিক নিঃসঙ্গতা যখন ক্ষুরস্য ধারায় চলেছে, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিও উঠে পড়েছে কাঠগড়ায়, তখন মুক্তির মতো প্রযোজনাকে সামনে এনে আমাদের নাগরিক অস্তিত্বের সাধুকঙ্কালকে খোলাসা করার জন্য থিয়েটার আর ত্রপা মজুমদারের আরও এক দফা সাধুবাদ পাওনা রইল।