যে জীবন, যে বাস্তবতা মনে গেঁথে আছে

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নাটকের দৃশ্য
জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নাটকের দৃশ্য

পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, রায়সাবাজার বা নবাবপুর রোডের হই-হট্টগোল ফুটে ওঠে মঞ্চে। গত শতকের ১৯৮৫ সাল ফিরে আসে। এর মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেলের ফিতে যখন ফট করে ছিঁড়ে যায়, আমরা বুঝতে পারি, শহীদুল জহির প্রণীত জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ শুরু হয়ে গেছে। আর সৈয়দ জামিল আহমেদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় গোটা উপন্যাস অবিকলভাবে দৃশ্যরূপ পেতে আরম্ভ করলে জাতীয় নাট্যশালার সীমায়িত মঞ্চটি দর্শকের সামনে ধীরে ধীরে অসীম হতে থাকে। ভেঙে যায় মঞ্চের চেনা গড়ন; এবং প্রসেনিয়ামকে নিজস্ব পন্থায় প্রসারিত করে খণ্ড খণ্ড দৃশ্যের সমবায়ে নির্দেশক নাটকের যে অনিন্দ্য অখণ্ড দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেন, আমাদের এখনকার জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতাসমেতই আমরা সেই জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাক্ষী হই। বলা ভালো, সেই বাস্তবতার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকি।

ভূমিকার পর বলা প্রয়োজন, এটি ‘প্রযোজনাভিত্তিক নাট্যসংগঠন’ স্পর্ধার পয়লা প্রযোজনা। এখানে শহীদুল জহিরের সঙ্গে সৈয়দ জামিল আহমেদের যুগলবন্দীতে জামিল কেবল শহীদুলের লেখাকেই অনুসরণ করেছেন তা নয়, উপর্যুপরি খণ্ড বাক্যের সমন্বয়ে গঠিত এ উপন্যাসে লেখকের যে বহুস্তরবিশিষ্ট বয়ানকৌশল ও বিন্যাস, নাট্যায়নের ক্ষেত্রে সেই বহুস্তরিক বিন্যাসও তিনি অক্ষুণ্ন রেখেছেন। গল্পের পটভূমি ১৯৮৫ হলেও নিমেষে সে গল্প চলে যায় ১৯৭১-এ। সেই যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার বদরুদ্দিন ওরফে বদু মাওলানার পৌরহিত্যে চলে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞ; সেই সময়কার কিশোর আবদুল মজিদের বোন মোমেনাসহ আরও অনেককে হত্যা করা হলো নৃশংস নির্যাতনের পর, এরপর অপরাধীরা পেল সাধারণ ক্ষমা; রাষ্ট্রীয় ও তত্কালীন বিচিত্রমুখী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসিত হলো তারা, নতুনভাবে উত্থান হলো তাদের, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের এই কাহিনিই আছে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। ফলে ১৯৮৫, ’৮৫ থেকে ’৭১, এরপর কখনো ’৭২, কখনোবা ’৮০, আবার ’৭১—অর্থাৎ ফ্লাশব্যাক, ফ্লাশব্যাকের ফ্লাশব্যাক, ফরোয়ার্ড, এরপর আবারও ফ্লাশব্যাক—এভাবেই নির্দিষ্ট সময় থেকে পিছিয়ে গিয়ে, আবার কখনো সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে—নানা সময়খণ্ডের মিশেলে চলতে থাকে গল্প। আর মঞ্চে এই ফ্লাশব্যাককে চিত্রিত করতে নির্দেশক অভিনবভাবে নির্মাণ করেন তাঁর সেট: নাট্যমঞ্চের ভেতরে কয়েকটি চাকাওয়ালা বাড়ি (পড়ুন: অভিনয়ক্ষেত্র) ব্যবহার করে নাট্য মুহূর্তগুলোকে তিনি নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। ফলে আবদুল মজিদের গল্প দেখতে দেখতে যে মুহূর্তে বদু মাওলনার গল্প শুরু হয়, আমরা দেখি যে মঞ্চে বাড়িসহ মাওলানা হাজির। মজিদের মা-বোনের গল্প এলে দেখা যায় তাদের বাড়ি। অন্য চরিত্রগুলো—খাজা আহমেদ আলী, মায়া রানী, মোহাম্মদ সেলিম—এদের বেলায়ও ব্যবহৃত হয় একই পদ্ধতি।

কিন্তু এই ঘনঘোর আবহের মধ্যে নাটকটির গল্প কারা বর্ণনা করেন? কারা এ গল্পের কর্তা? আবদুল মজিদের পাশাপাশি এ নাট্যে গল্প এগিয়ে নেয় মহল্লাবাসী, মানে শহীদুল জহিরের সেই ‘মহল্লার লোকেরা’। মূলত মহল্লাবাসীই বর্ণনাকারী। নাট্যমঞ্চে আসে কিছু আঁকা চরিত্র। আর তাদের সঙ্গে যুক্ত হন রক্তমাংসের অভিনয়শিল্পীরা। এই দুইয়ের রাখীবন্ধনে মঞ্চে নির্দেশক যে মহল্লাবাসী তৈরি করলেন, তা একই সঙ্গে নতুনত্ব ও চমক—দুই-ই যোজনা করতে পেরেছে। বরাবর মহল্লাবাসীর সামনেই ঘটে তাবৎ নাট্যক্রিয়া এবং অভিনয়ের মাধ্যমে তারা সেই ক্রিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণকারীও। তাই ফ্লাশব্যাক যখন ঘটে, দেখতে পাই মঞ্চের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে আরেকটি মঞ্চ। আর এতে করে প্রসেনিয়াম তার দ্বিমাত্রিক গড়ন ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠা পায় ত্রিমাত্রিক ভূখণ্ডে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, এ প্রযোজনার প্রায় পুরোটাই বর্ণনানির্ভর, স্বতন্ত্রভাবে চরিত্রের সংলাপ যা আছে, তা সিন্ধুর মধ্যে এক বিন্দুমাত্র। কিন্তু এখানে আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক ও আহার্য অভিনয়, অভিনেতাদের শারীরিক সক্ষমতা এবং বর্ণনার শিল্পময়তা—সবকিছুর এমন অপূর্ব মেলবন্ধন, সংলাপ যে নাটকের অচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা আলাদা করে আমাদের মনেই পড়ে না। তবে বদু মাওলানার চরিত্রে শরীফ সিরাজ, মোমেনা চরিত্রে মহসিনা আক্তার, ইয়াসমিন চরিত্রে শারমিন আক্তার শর্মী এবং কিশোর ও যুবক আবদুল মজিদ চরিত্রে যথাক্রমে সউদ চৌধুরী ও শোভন দাসের অভিনয় বিশেভাবে দাগ কেটে থাকে মনে। এঁদের মতো দাগ না কাটলেও অন্য চরিত্রদের অভিনয়ও ছিল সংগতিপূর্ণ। তাই ভালো লাগে।
দু ঘণ্টার এ নাটকে মাত্র জনাবিশেক লোক দিয়ে অদ্ভুত নান্দনিক সৌকর্যে অজস্র মানুষের আবহ আনতে পেরেছেন জামিল। এ ক্ষেত্রে কোরাসকে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, বাংলাদেশের থিয়েটারে এমন প্রয়োগ সম্ভবত নতুন। এ নিয়ে শুধু এটুকু বলি, কোরাস যখন সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি বর্ণনা করে বা দারুণ ক্ষিপ্রতায় মুহূর্তের মধ্যে কেবল শরীর দিয়ে মঞ্চে ফোটায় দৃশ্যের ফুল, অথবা প্রযোজনার কোনো অংশে অন্য কোনো বর্ণনাকারীকে সংগত দিতে দিতে একই লয়ে যখন তারা মৃদুভাবে শরীর দোলাতে থাকে, দেখতে মনোরমই লাগে। একটি প্রশ্নও উঁকি দেয় মনে, ১৯৭১ থেকে ’৮৫-এর সেই কালখণ্ডের অস্থিরতাকে কি নির্দেশক কোরাসের এই দুলুনির মধ্যে দিয়ে ধরতে চেয়েছেন?

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় আলো ও মঞ্চ পরিকল্পনাও সৈয়দ জামিল আহমেদের। একটি নাটকে মঞ্চ আর আলো কী সুষমামণ্ডিতভাবে ব্যবহৃত হয়ে প্রযোজনার সঙ্গে মিলেমিশে যেতে পারে, সমসাগ;ময়িককালে তার উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবে এ নাটক। আর পোশাক পরিকল্পনা? অভিনয়ের মতো পোশাক পরিকল্পক হিসেবেও মহসিনা আক্তার সফল। সব কিছুর সঙ্গে পোশাক মানিয়ে গেছে বেশ।
তবে বর্ণনাকে ছাপিয়ে আবহ সংগীত কখনোবা কানে এসে বিঁধেছে, সবশেষে এটুকু খুঁতের কথা যদি বলি, পুনরায় এ কথাও বারবার বলতে হবে যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহজুড়ে একটানা মঞ্চস্থ হলো যে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, সেটি যতটা চোখ ধাঁধিয়েছে, মনে গেঁথে আছে তার চেয়ে বেশি। এ নাটকে রয়েছে কবিতার চিত্রকল্প, কেউ বলবেন, খুঁজলে কি চিত্রকলা বা চলচ্চিত্র-দৃশ্যের মহিমাও এখানে পেতে পারি না?

আদতে ভালো শিল্প তো অভেদ, অখণ্ড কলাবিদ্যাকেই সে অঙ্গে ধরতে চায়।