যুদ্ধদিনের ছবি কতটা ভাবায়

শবনম ফারিয়া, জিনাত শানু স্বাগতা ও ইরফান সাজ্জাদ। ছবি: প্রথম আলো
শবনম ফারিয়া, জিনাত শানু স্বাগতা ও ইরফান সাজ্জাদ। ছবি: প্রথম আলো
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র যে কটাই নির্মিত হয়েছে, তার প্রতিটিই আমাদের নানাভাবে প্রভাবিত করে। শিল্পীদের বেলায় তো সেই প্রভাব আরও বেশি। তিন অভিনয়শিল্পী আমাদের অনুরোধে আবারও নতুন করে দেখেছেন তিনটি কালজয়ী যুদ্ধের ছবি। লিখেছেন সেই ছবি দেখার পরের অনুভূতি।
জয়যাত্রা ছবির দৃশ্য
জয়যাত্রা ছবির দৃশ্য

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমি শুধুই কেঁদেছি
শবনম ফারিয়া, অভিনেত্রী

শবনম ফারিয়
শবনম ফারিয়

বাবার কাছ থেকে শোনা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের সঙ্গে অদ্ভুত একটা মিল আছে জয়যাত্রার। আমি বই পড়ে যতটুকু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জেনেছি, তার চেয়ে বেশি জেনেছি বাবার কাছ থেকে। হয়তো সন্তানের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতেই তার এই চেষ্টা ছিল। হয়তো কখনো তাই এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না!
নাহ্, টপিকের বাইরে চলে যাচ্ছি।
আজকে বলব আমার অন্যতম প্রিয় ছবি জয়যাত্রা নিয়ে। নির্মাতা তৌকীর আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এই ছবিটি দিয়ে।
এত নিখুঁত কাজ। বলতে দ্বিধা নেই আমি অভিনেতা তৌকীর আহমেদের চেয়ে নির্মাতা তৌকীরের বড় ভক্ত। আমার এখনো মনে আছে, এই ছবির ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার যখন দেখি, আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ছবির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমি শুধুই কেঁদেছি! আমি দেশের ব্যাপারে অনেক আবেগী, মাবিয়া যখন স্বর্ণপদক নেন, আমি অঝোরে কেঁদেছি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ম্যাচ জেতে, খুশিতে আমি কাঁদি। ওয়াসফিয়া এভারেস্ট জয় করেন, আমি কাঁদি।
মূল প্রসঙ্গে আসি, ছবির শুরুর দিকে কট্টর হিন্দু আবুল হায়াতের গোসলের দৃশ্য আমি কক্ষনো ভুলব না। বারবার ডুব দেওয়া কিন্তু সেই একই মানুষের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি পানিতে ছুড়ে ফেলা কিংবা হিন্দু–মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে একই পাতে খাবার খাওয়া—সবই বাংলার অসাম্প্রদায়িকতার এক অপূর্ব চিত্র।
আমার কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, কোন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র আবার বানানো হলে আমি অভিনয় করতে চাই। আমি বলেছিলাম, জয়যাত্রা। এর ‘হাওয়া’ চরিত্র অভিনয় করতে চাই আমি। সন্তান হারানোর যে ব্যথা, অন্য এক শিশুর মধ্যে নিজের সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার যে আকুতি, ছোবল মেরে চিলের মুরগির বাচ্চা নিয়ে যাওয়া দেখে মায়ের নিজ সন্তানকে জড়িয়ে ধরা—এখনো মনে পড়লে আমার গায়ে কাঁটা দেয়।
তিন দিন পর আলনার পেছন থেকে বের হওয়ার পর চাঁদনীর সেই চোখের চাহনি, কিংবা তারিক আনাম খানের মৃত্যুর পর চারদিকে ব্রিফকেস ফেটে টাকা ছড়িয়ে পড়া—সব দৃশ্যই হৃদয়ে গেঁথে থাকার মতো। নাসিম ভাই, দিনার ভাই কিংবা শামস সুমন—মনে হচ্ছিল একে অন্যের সঙ্গে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করছেন। সবচেয়ে বড় কথা, হুমায়ুন ফরীদি কেন ‘লিজেন্ড’–এর প্রমাণ দেওয়ার জন্য যথেস্ট স্পেস এই ছবিতে না থাকার পরেও তিনি তাঁর সেরাটাই দিয়েছেন। এবং সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন।
যার কথা না বললেই নয়, সেই শিশুটি, ভাত খাওয়ার দৃশ্যে অপলক তাকিয়ে থাকা, দাদা–মা–ছোট ভাই—সব হারিয়েও একটা কচুরি ফুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি, কী অপূর্ব! আচ্ছা, সেই ছেলেটি নিশ্চয়ই এখন বড় হয়ে গেছে, সেকি এখনো অভিনয় করে?
পাটাতন থেকে বের হওয়ার পর যখন মা বুঝতে পারেন, তাঁর সন্তান আর নেই, আমার মনে হয়েছে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম দৃশ্য! বুক ফেটে কান্না আসে সে সময়।
মাহফুজ ভাই এই সিনেমায় তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয়টাই করেছেন বলে আমার বিশ্বাস।

আলোর মিছিল ছবির দৃশ্য
আলোর মিছিল ছবির দৃশ্য

ছবির একেকটা চরিত্র বাংলাদেশের একেকটা রূপ
ইরফান সাজ্জাদ, অভিনেতা

ইরফান সাজ্জাদ
ইরফান সাজ্জাদ

যে মিছিলের মধ্য দিয়ে আলোর মিছিল ছবির শুরু হয়, সেখান থেকেই ছবিটায় বুঁদ হয়ে যেতে হয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের আবেদন যেন কোনোকালেই ম্লান হওয়ার নয়। ছবির ‘আলো’ অর্থাৎ ববিতার প্রাণোচ্ছল অভিনয় নিয়ে তো বলার কিছুই নেই। তাঁর আলাপে পরে যাব। আমি আগে বলতে চাই আনোয়ার হোসেনের ‘শহীদ’ চরিত্রটি নিয়ে। ছবির শুরুর দিকেই তাঁর সংলাপ ‘বিধ্বস্ত বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলব’—এর প্রাসঙ্গিকতা আমি এই সময়ে বসেও অনুভব করছি। সংলাপটা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হলো আমরা তো সোনার বাংলা গড়ার সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ৪৮ বছর পরে এসেও ছবিটা দেখতে বসে এত প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, যা বলতে গেলে হয়তো লেখা বাড়তেই থাকবে!
এই ছবির একেকটা চরিত্র যেন বাংলাদেশের একেকটা রূপ। একদিকে রাজ্জাক অভিনীত চরিত্র ‘মুক্তিযোদ্ধা রানা’ যেমন আমাদের বিপ্লবী বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে খলিলউল্যাহ খানের ‘আলিম’ চরিত্র মনে করিয়ে আলোর আড়ালের অন্ধকারের কথা। ‘আলো’র প্রাণবন্ত হাসি আমাকে প্রতি মুহূর্তে নির্মল বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, আর ‘ছাত্রনেতা শহীদ’রূপী আনোয়ার হোসেন উদ্দীপ্ত তারুণ্যের প্রতীক।
মাত্রই স্বাধীন হওয়া একটা দেশে যে যুদ্ধজয়ের পরেও কত যুদ্ধ, কত সংগ্রাম থাকে তা আলোর মিছিল দেখেই উপলব্ধি করা যায়। আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের সিনেমাই দেখেছি। কিন্তু বেশ আক্ষেপ নিয়েই বলতে হচ্ছে, আলোর মিছিল–এর মতো সমৃদ্ধ একটা সিনেমা আমি এর আগে দেখিনি। এবারই প্রথম দেখলাম। আর এই প্রথম দেখার অনুভূতি হার মানিয়েছে সাম্প্রতিক কালে দেখা সমসাময়িক সব ছবিকেও।
মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী অবস্থাকে যেভাবে এই ছবিতে নির্মাতা মিতা তুলে ধরেছেন, তা ছবি দেখার প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে ভাবিয়েছে। ছবির সংলাপও যে মনে আর মস্তিষ্কে এতটা প্রভাব ফেলে তা বলার মতো না। যুদ্ধ–পরবর্তী সময় কিন্তু আমি শিল্পীদের সংলাপে সংলাপে খুঁজে পাচ্ছিলাম রক্তক্ষয়ী নয় মাসের বিভীষিকার আঁচ।
‘এই পৃথিবীর পরে কত ফুল ফোটে আর ঝরে’—এই গান তো ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। একান্নবর্তী পরিবারের আদরের মেয়ের জন্য বসানো গানের আসরের এই অংশটা মনকে অদ্ভুত এক প্রশান্তি দেয়। একই ছবিতে এত ধরনের আবেগ আর অনুভূতির মিশেল সবাই ঘটাতে পারে না।
এই ছবির শেষ দৃশ্যে ‘আলো’র নিথর দেহকে কোলে তুলে ‘রানা মামা’ যখন বাড়ি ফেরেন আর পেছনে বাজতে থাকে গান—সেই দৃশ্য দেখে বুকের ভেতরে পাথর মতো ভারী বোধ হয়। এমন অভিনয়, এমনভাবে চরিত্রধারণের জন্য যে পরিমাণ পরিপক্ব হতে হবে, তা হতে পেরেছি কি না জানি না। তবে সুযোগ পেলে আমি এই দৃশ্যের অংশ হতে চাই। আবার আলোর মিছিল তৈরি হলে এর অংশ হওয়ার স্বপ্ন আমার।

আগুনের পরশমণি ছবির দৃশ্য
আগুনের পরশমণি ছবির দৃশ্য

কী দুঃসহ এই বন্দিত্ব! 
জিনাত শানু স্বাগতা, অভিনেত্রী

জিনাত শানু স্বাগতা
জিনাত শানু স্বাগতা

আগুনের পরশমণি ছবির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা প্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের। তাই সেটা নিয়ে লেখা আমার জন্য বেশ রোমাঞ্চের, আবার ভয়েরও। মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত িনয়ে নির্মিত এই ছবিতে একটি পরিবার আর একজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে ওই সময়ের নানান রূপ, নানান আবেগ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন, পতাকা নিয়ে রেষারেষি, ধর্ষণ, ধর্মীয় আবেগ–অনুভূতি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, গ্রেনেড, কাটা রাইফেল, গণকবর, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম—প্রতিটি বিষয়ই ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই সময়ের উৎকণ্ঠায়, উত্তেজনায়। এক মুক্তিযোদ্ধাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ের সাধারণ মানুষের, নারী–পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এই ছবির মধ্য দিয়ে একদম পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছি আমি।
এই ছবি দেখে আমি যুদ্ধের ৯ মাসের প্রতিকূলতা, অভাব, ভয়, আতঙ্ক, এরপর সবার ভেতর জেগে ওঠা দেশপ্রেম আর স্বাধীন দেশ দেখার আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করেছি। আগুনের পরশমণির সবচেয়ে মজার ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এতে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে বিভিন্ন দৃশ্যে আবহাওয়ার নানা রং দিয়ে বুঝিয়েছেন পরিচালক। এই পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ার মতো।
ছবির পুরোটা সময়জুড়ে আমি নিজেকে পরাধীনরূপে খুঁজে পেয়েছি। ছবিতে বিপাশা হায়াতের বন্দিদশা দেখে আমার নিজেকেই প্রতি মুহূর্তে বন্দী মনে হচ্ছিল। কী দুঃসহ এই বন্দিত্ব!
ছবিটির শেষও হয় একধরনের দীর্ঘশ্বাস বুকে জমিয়ে। আমি যতবার এটা দেখি, ততবারই মনে হয় অসমাপ্ত থেকে গেল গল্পটা। যেখানে নায়ক যুদ্ধ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সারারাত কাতরাতে থাকে, যুদ্ধ করতে থাকে জীবনের জন্য, আমার মনে হচ্ছিল ভোরে হয়তো একজন ডাক্তার আসবেন, কিন্তু তা হয় না। আগুনের পরশ, মানে রৌদ্রদীপ্ত বিজয়ী ভবিষ্যতের দিকে হাত বাড়িয়ে শেষ হয়ে যায় ছবিটা। আমাদের আর জানা হয় না, ‘বদি’ কি ফিরে এসেছিল? পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ? প্রতিবার আগুনের পরশমণি দেখার পর এই প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে থাকে মনে।